রিলে তখন সেই তরুণ অথবা বলা যায় যুবাকে দেয়ালে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বর্তমান অসাম্যের জাগ্রত প্রহরী এই পুলিশের গুলি, ওর মাথায় বুকে পেটে, জঙ্ঘায় তুমি দৃশ্যটি দেখে কেঁদে ফেলেছিলে। সে কেমন সারমন দেবার মতো বলতে বলতে শেষে বলে ফেলল, তুমি কেঁদেছিলে কী না!
সোমা ঘাড় নিচু করে সম্মতি জানাল।
অজিতেশ বলল, মুখটা দেখ। চোখ দেখ। ফের সে রিল ঘুরিয়ে দিল।
সবাই ফের ছবিটা দেখল।
অজিতেশ বলল, আমি চাই মুখটা সোমা মুখস্থ করে ফেলুক।
সোমা বলল, আমার মনে থাকবে।
অজিতেশ বলল, মুখটা কিন্তু যুবার আসল মুখ নয়। মেক—আপ নেবার পর।
বিনু বলল, তারপর কী!
এবং সঙ্গে সঙ্গে অজিতেশ রিল বন্ধ করে দিল। তারপর বসে পড়ল। এখন ওরা আগের মতো বসে রয়েছে। টেবিলে স্ট্যান্ড তিনটে পা যেন। জিরাফের মতো গলা উঁচু করে রেখেছে। এবং দেখলে মনে হবে এই নীল অন্ধকারে এ প্রজেকটারও একটা জীবের মতো। যেন ওরা এখন সাত জন। ওর জন্যও আলাদা একটা চেয়ার দরকার।
অজিতেশ বলল, এবারে সোমা তোমাকে বলতে চাই, সেই অভিনেতাকে তুমি কফি—হাউসে দেখেছিলে। তুমি এত সুন্দর, সবাই তোমাকে দেখছে, অথচ তুমি ওকে দেখছ, বারবার ওকে দেখছ, সেও এমন সুন্দরী যুবতী ওকে এত দেখছে ভেবে অবাক হয়নি, কারণ সে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছে, এবার থেকে অনেকেই ওকে দেখবে তাতে বেশি কী। আসলে ব্যাপারটা সেখানেও নয়। সে তোমার মতো মেয়ের রূপ ভুলতে পারছিল না। ওর চোখে ছিল উদাসীনতা। যেন এসব কিছু না। আরও সে ওপরে উঠবে। বহু সুন্দরীদের সে ক্রমে লোভনীয় বস্তু হয়ে যাবে।
সোমা বলল, অজিতেশ, তুমি আমাকে ঘাবড়ে দিও না।
অজিতেশের গোঁফ আবার লম্বা হয়ে গেল। বলল, সেই অভিনেতার গালে দাড়ি না থাকলে কেমন দেখায়! তুমি ভাবছিলে ওকে যেন কোথায় দেখেছ! কত কালের চেনা, কিন্তু ঠিক কারও সঙ্গে মেলাতে পারছ না। ছবির মতো ওর মুখে দাড়ি গোঁফ ছিল না। কিন্তু চোখ দুটো ছিল একরকমের। তুমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলে না।
সোমা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, না না! মিথ্যে কথা।
অজিতেশ বলল, সোমা, তুমি বসো। উত্তেজিত হবে না।
সোমা একেবারে বসে গেল। সে চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে ছাদে যেন কী দেখছে। আসলে কিছুই দেখছে না। শূন্য দৃষ্টি। সে বলতে পারত, তুমি ঠিক বলেছ অজিতেশ। এতদিনে আমি ওকে চিনতে পেরেছি।
অজিতেশ বলল, চারপাশে যখন দুর্ঘটনা, যখন হত্যাকাণ্ড, সুখী রাজপুত্রেরা পৃথিবীতে সু—সময় আনবে বলে যখন বাজি ধরেছে তখন তোমরা নিশ্চিন্তে ছবি দেখবে, কোনো ভাবনা থাকবে না, এটা তোমার বন্ধুদের কেউ চাইল না। বলেই সে আবার ঘাড় নিচু করে দিল। সেই ক্যানভাসের ব্যাগ থেকে বের করল একটা খাতা। বলল, এখানে সবাই যদি একটা চিঠি লিখে দেন মনীষ দত্তকে। লিখবেন, যে যেভাবে পারবেন লিখবেন। চিঠিটা মনীষ দত্তকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ওর নাম ঠিকানা থাকবে। লাল কালিতে লিখবেন।
বিনু আর এখন কিছু বলতে পারছে না। সে দেখল অজিতেশ এখন বাজিকরের মতো ভারি সব সুন্দর সুন্দর খেলা দেখাচ্ছে। সে খাতাটা নিয়ে লিখল, মনীষ দত্ত…।
সুধীর লিখল, আরও কিছু।
অসিত বলল, আমিও কিছু লিখে দিচ্ছি।
অশোক বলল, কী লিখব বুঝতে পারছি না।
তারপর অজিতেশ লেখাগুলো বের করে একটা লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দিল। দ্যাখ তো দুটো লেখাতে মিল আছে কিনা।
একেবারে এক। হাতের লেখা এক।
অজিতেশ এবারে দু হাতের ওপর টেবিলে ঝুঁকে দাঁড়াল। বলল, অশোক তুমি থ্রেটনিঙের চিঠি দিয়েছিলে! ছেলেমানুষী। আসলে তোমার কোনো মতলবই ছিল না খুন—টুন করার। সেদিন কফি—হাউসে এমন একজোড়া পায়রা আকাশের নিচে খুব বকম বকম করে উড়ে বেড়াচ্ছে বলে হিংসে হয়েছিল। কী করে জব্দ করা যায় ভেবেছিলে। কত উড়ো চিঠি আসছে, ভয়ে পুলিশে উড়ো চিঠি জমা দিচ্ছে না এসব ভালো করে জানতে। মনীষকে একটু ঘাবড়ে দিয়ে কাপুরুষের মতো প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে! চিঠিটা তুমি নিজের হাতেই রসুলকে দিয়ে গেছিলে। নাম বলেছিলে অঞ্জন? ঠিক?
অশোক বলল, আমি কিছু বলব না।
সুধীর বলল, কিন্তু ও তো একচুয়েলি খুন করেনি!
অজিতেশ হাসল। খুব প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মতো হাসল। বলল, না। অশোকের ঐ চিঠি লেখাই সার। ওর আর কিছু করার ক্ষমতা নেই।
অসিত বলল, তাহলে!
সোমা তখন বাধা দিয়ে বলল, হঠাৎ কেউ কেউ আসত দেখা করতে। কিন্তু দেখা হত না।
সুধীর বলল, আমি একদিন এসে দেখা পাইনি তোর! কেবল নাম জানতে চায়। যত বলি, এলেই চিনতে পারবে, নাম বলার দরকার হবে না, ততই তোমার লোকেরা ক্ষেপে যায়। রাগ করে শেষে চলে গেছি। হাতের কাছে ফোন থাকলে একচোট নিতাম। তারপর মনে হয়েছে, যাকগে বড়লোক হয়ে গেলে এমনি হয়ে থাকে। নালিশ করার প্রয়োজন মনে করিনি। আগেই বলেছিলাম, না হলে এ—থেকে তোমরা একটা ক্লু বের করার চেষ্টা করবে।
অজিতেশ বলল, ওটা একদিনই হয়েছে। অথচ এমনভাবে একটা ভয়ের ভিতর তোমরা পড়ে গেলে যে মনে হত বারবার এটা তোমাদের জীবনে ঘটছে। নতুবা বাথরুমে কেউ ঢুকে যাবে না। আয়নায় কারও ছবি ভেসে ওঠে না। কীভাবে এইসব সুখী রাজপুত্রেরা যে তোমাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, বুঝতে পারছ না! ভয়ংকর একটা ইলুসানের ভিতর ডুবে গেছিলে।
সোমা বলল, চিঠিটা পাবার পর আমি কেন যে ওকে বললাম, জানি সে আসবে!