অজিতেশ কোনো কথা বলল না। ওর হাতের ব্যাটনটা মাথার ওপর তুলে দিল শুধু। অর্থাৎ বলতে চাইল যেন, চুপ। অজিতেশের মোটা গোঁফ কিছুটা ঝুলে পড়েছে মনে হল। অজিতেশের খাটো চুল, খাড়া চুল আরও খাড়া হয়ে গেছে। বিনু ভাবল, মাথা নিচু করে দেখবে মুখটা।
কিন্তু বিনুর তখন মনে হল, সোমা উঠে দাঁড়িয়েছে। সে কেমন এক অপার্থিব চেহারায় ওদের দেখছে। যেন সোমা ইচ্ছে করলেই বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে এখন। এটা কী অজিতেশ কোনো মন্ত্রতন্ত্র আওড়ে এমন করছে, না কী সে শালা ভয় পেয়ে চোখে গণ্ডগোল দেখছে। সে বলল, সোমা, তুমি এ—ভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।
অজিতেশ বলল, চুপ। কথা না। শব্দ!
শব্দ!
হ্যাঁ শব্দ!
কীসের শব্দ!
কেউ কাঠের সিঁড়ি ধরে উঠে আসছে!
হ্যাঁ। তাইতো। কাঠের সিঁড়ি!
তুমি শুনতে পাচ্ছ সোমা?
না তো!
অজিতেশ বলতে বলতে উত্তেজনায় উঠে পড়েছিল। কিন্তু সোমা শুনতে পায়নি ভেবে সে কেমন হতাশ গলায় দুস বলে বসে পড়ল। হল না।
অসিত বলল, অজিতেশবাবু, আর যাই করুন আমাদের ভয় পাইয়ে দেবেন না। ঘরের এমন চেহারা হয়, আর সোমাকে যা দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে যেন কোনো পরলোক—টরোলোকে চলে এসেছি।
অজিতেশ বলল, বুঝলেন অসিতবাবু, পৃথিবী ভারী আশ্চর্য জায়গা। মানুষ আরও আশ্চর্য। বলতে বলতে ওর গোঁফটা এবার সোজা হয়ে গেল।
বিনু বলল, তুই কী বলতে চাস বুঝতে পারছিনে!
বলছি, এই মৃত্যুর জন্য তোমরা সবাই দায়ী।
তার মানে! অশোক লাফিয়ে উঠল। যেন ভিতরে একটা চোট খেয়েছে।
অজিতেশ বলল, রাগ করছিস কেন! যা ঘটনা তাই বললাম।
সুধীর বলল, অ্যাবসার্ড ঘটনা। এর সঙ্গে আমরা যুক্ত নই।
যুক্ত আছিস। এসব নানাভাবে জানতে হয়। সোমাও কিছুটা দায়ী।
বিনু বলল, কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে তোর বুঝি এটা মনে হয়েছে।
অজিতেশ বলল, সোমা, প্রথম দিন থেকে আরম্ভ করা যাক।
সোমা ফের বসে পড়ল। চারপাশের দরজা বন্ধ। ঘরটাকে সামান্য উষ্ণ রাখার আর দরকার হচ্ছে না। শীতকাল চলে যাচ্ছে। সোমা কিছু বলল না। সে শুনে যাচ্ছে। সে অজিতেশের গোঁফ নড়তে দেখল শুধু।
অজিতেশ বলল, প্রথম দিন থেকে মানে, সেই ছবি দেখার দিন থেকে, ছবিটা ছিল, বলে ছবির নাম এবং পরিচালকের নাম বলল। তোমরা সোমা সেই ছবিটাই তো দেখেছিলে!
সোমা মুখ তুলে তাকাল। ওর শরীর কাঁপছিল যেন। চোখ দুটো মায়াবী, এবং যেন জলছবির মতো নিরুপায় মুখ। সে বলল, হ্যাঁ। আর তখনই মনে হল ওর সাদা সিল্ক থেকে একটা চুমকি সত্যি জোনাকি হয়ে বাতাসে উড়ে গেল।
অজিতেশ বলল, তোমরা বুঝতে পারছ আমার খবরাখবর ঠিক।
বিনু হঠাৎ ক্ষেপে গেল। বলল, ধুস শালা, তুই একটা চারশো বিশ। তোকে তো আমি বলেছিলামরে, সোমা কী বই দেখার পর মনীষকে নিয়ে কফি—হাউসে গিয়েছিল। এর আবার খবরাখবর ঠিক বেঠিক কী।
অজিতেশ বেশ অবিকল নকল করে বলল, পৃথিবীটা ভারি মজার জায়গা হে বাপু। অত সহজে ক্ষেপে গেলেই চলে! বলেই সে বলল, ওটাতে একটা দৃশ্য ছিল, সোমা তুমি মনে করতে পার কিনা দ্যাখো। আমি বলার চেয়ে এখানে দেখ। প্রজেকটার দিয়ে তোমাকে সেই রিলটা দেখিয়ে দিচ্ছি বরং। বলে সে ওর লম্বা ব্যাগ থেকে সব টেনে টেনে বের করতে থাকল। সে বেশ নুয়ে থাকল ব্যাগের ওপর। ক্যানভাসের ব্যাগ, কিছুটা জাদুকরের মতো ওকে এখন দেখাচ্ছে। ক্যানভাসের ব্যাগ থেকে টেনে নামানোর চেয়ে সে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ উপুড় হয়ে থাকল। সাপুড়ে ওঝার মতো সে যেন বের করেই জিনিসটা সবার ওপর ছুঁড়ে দেবে। সাপ—টাপের মতো কিছু একটা ছুঁড়ে দেবে—এমন মনে হচ্ছে ওর আচার—আচরণ দেখে। এবং সবার এতে ভয় পাবার কথা। চারপাশের মানুষ জনের ভিতর একটা এখন বিস্ময়কর সতর্কতা। সাপটা কার ওপরে এসে পড়বে কেউ বলতে পারে না। তবু নিজেদের রক্ষা করার জন্য সবাই সতর্ক থাকছে। যেন ছুঁড়ে দিলেই দুহাতে ঠেলে ফেলে ছুটতে পারে। কেবল সোমা এসব কিছু ভাবছে না। সাত আট দিনের মাথায় অজিতেশ এতদিনের একটা রহস্যকর ঘটনার সমাধান করতে চায়। ওর মনে মনে হাসি পেল।
অজিতেশ হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়াল। সবার দিকে চোখ ঘোরাল। কী দেখল চোখ ঘুরিয়ে। তারপর বলল, এই দেখুন। সে টেবিলে স্ট্যান্ড বসিয়ে সামনের সাদা রঙের দেয়ালে আলো ফেলে ছবির রিলটা দেখাবে বলে বোতাম টিপে দিল। এবং তখনই দেয়ালে এক তরুণের ছবি। সে একটা মরুভূমির মতো বালিয়াড়ির ওপরে ছুটছে। চারপাশ থেকে পুলিশের রাইফেল, বেয়নেট চার্জ করার জন্য ওরাও ছুটছে। এবং সেই তরুণ এই বয়স তেইশ—চব্বিশ হবে, মুখে সামান্য দাড়ি, চোখ বড়, সে সব কিছু অন্যায় শোষণ দূর করার জন্য শহরের রাস্তায়, গ্রামের নির্জনতায়, চারপাশের মাঠে, সুন্দর সূর্য উঠলে শারীরিক কৌশলে এবং এক আশ্চর্য দৃঢ়তায় সে যখন পৃথিবীতে সুখী রাজপুত্র, তখনই অজিতেশ অনেক দূরে থেকে বলার মতো বলে চলল, সোমা তুমি ওকে ভালো করে দেখ। শৈশবে অথবা যখন তুমি নানাবর্ণের স্বপ্নের ভিতর বড় হয়ে উঠেছিলে, তখন তোমার বাবার আত্মহত্যা, তোমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তুমি জানতে কেন তোমার বাবার এই আত্মহত্যা, তুমিও স্বপ্ন দেখতে, কোনো সকালে ঠিক এই ধরণিতে আশ্চর্য এক সকাল আসবে। সব মানুষ সুখী, তোমার বাবাকে সেখানে তেলেভাজা চুরি করে খেতে হবে না, তোমার মাকে…বলে সে থামল কিছুক্ষণের জন্য। আজীবন এমন একটা সকাল আসবে ভেবেছিলে। এবং এমন একজন তোমার পাশে কেউ থাকবে যার চোখ বড়, যে সুখী রাজপুত্রের মতো স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে।