ধরুন দিচ্ছি।
অজিতেশ বলল, হ্যাঁ, আমি অজিতেশ বলছি।
শোন, আমি সোমা।
বুঝতে পারছি।
আমার ঘর ঠিক। কখন আসছ?
রাতে।
রাত কটায়?
এই ধর আটটায়।
সবাইকে তো জানিয়ে দিতে হবে।
তোমায় ব্যস্ত হতে হবে না। বিনু সব করছে।
বিনু না থাকলে কী যে হত!
কেউ কেউ এ—ভাবে থেকে যায়। মানুষ কখনও একেবারে নির্বান্ধব হয় না।
সোমা উত্তরে কিছু বলতে পারল না। কেবল অজিতেশ বলল, সোমা, তোমরা সামান্য স্ফুলিঙ্গ দেখেই ভয় পেয়ে গেলে!
সোমা হঠাৎ অজিতেশ এমন কথা বলছে কেন বুঝতে পারছে না।
সে বলল, স্ফুলিঙ্গ মানে!
আরে এই যে ছেলে—ছোকরারা বিপ্লব করছে না!
তা করছে।
যাক শোনো, আটটা।
আচ্ছা, ফোন ছেড়ে দিল সোমা।
বিকেলে ফোন করল ফের অজিতেশ। আচ্ছা তোমার আত্মীয়স্বজন কে কে তোমাদের বাড়িতে রেগুলার আসত।
রেগুলার কেউ আসে না। আসলে মনীষ এত বেশি ব্যস্ত ছিল নিজেকে নিয়ে, আমি কলেজ নিয়ে, এবং সন্ধ্যায় মনীষ বাড়িতে থাকতেই ভালোবাসত।
তবু কে কে আসত জানতে পারলে ভালো হয়।
সোমা বলল, যে গেছে তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আমার ইচ্ছে নয় এজন্য অন্য কেউ হ্যারাস হোক।
হ্যারাস হবে কিনা জানি না, তবে এটা আমি যা ভেবেছি, এক আজগুবি ঘটনা। এমন হয়, সুতরাং এমন যখন হয়, তখন ভীষণ হাসি পায়।
সোমা আর কিছু বলল না। ফোন রেখে দেবে ভাবল। তখনই অজিতেশ বলল, আমাদের সিটিং অনিবার্য কারণে আজ বন্ধ। সিটিং হচ্ছে চারদিন পর। বিনুকে ফোন করে দিচ্ছি। সেই খবর দিয়ে দেবে।
সোমা কী বলবে ভেবে পেল না। সে শুধু বলল, আচ্ছা।
এবং রাতে সোমা আর মনোরমা একঘরে। সারারাত সোমার কেমন ভয় ভয় করতে থাকল ফের। সারারাত মনীষের সেই মরা মুখ কেমন বাতাসে ভেসে ভেসে কাছে চলে আসছিল। আর সোমা ঢেউ দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল। সোমা ভয়ে ঘামছিল। শীতেও সে ঘামছিল। সে একবার ডাকল, মনোরমা। মনোরমা উঠলে বলল, জল। তারপর বলল, তুই কিছু দেখতে পাচ্ছিস।
মনোরমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল, না তো!
কোনো শব্দ?
সে বলল, না তো!
আমার কেবল কী যে মনে হয়!
মনোরমা বলল, ও কিছু না! মনের ভুল!
এ—ভাবে রাত কেটে যেত, সোমা রাতে ঘুমোতে পারত না। একটা কী যে রহস্য থেকে গেল। এখন আর কিছু মনে হয় না। এখন এ—বাড়িতে কেউ এসে মনীষকে খুন করতে পারে মনে হয় না। সব কেমন মনীষের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল। এখন বদলে মনীষ বাতাসে ভেসে ভেসে চলে আসে। এবং একটা মমির মতো ঠিক ওর সামনে নাকের ডগায় ভেসে থাকে। সে ছুঁয়ে দিতে পারে না, ছুঁয়ে দিলেই যেন সোমাও মমি হয়ে যাবে। সোমা কিছুতেই মমি হতে চায় না। সে বাঁচতে চায়। সে কখনও রাতে চিৎকার করে ওঠে, আমাকে বাঁচতে দাও তোমরা। আমাকে এ—ভাবে ভয় দেখিও না।
তারপর যেমন কথা ছিল, সেই বড় হলঘরের মতো ঘরে লম্বা টেবিলের চারপাশে চুপচাপ বসে পড়ার, যেমন কথা ছিল যার যার আসার এবং যেভাবে ঠিকঠাক ছিল ঘর রাখার, সেভাবে ঘর রেখে এখন একটা অদ্ভুত নির্জনতা এই ঘরে। নীল রঙের আলো জ্বলছে ঘরে। ঝাড়বাতিগুলোতে ছোট ছোট আলোর চুমকি। সোমা পরেছে খুব সুন্দর সাদা সিল্ক। তার গায়ে জোনাকি পোকার মতো চুমকি বসানো। সে বসেছে টেবিলের ঠিক মাঝখানে। একে মাঝখানে ঠিক বলা যায় না অবশ্য, কারণ বড় টেবিলটা ডিনার টেবিলের মতো, অনেক বড়, খুব বড় এবং ডিমের মতো আকৃতি টেবিলের। সূচলো ডিমের আকৃতি বলে, সোমা সূচলো দিকটায় বসে রয়েছে। তার মুখ দক্ষিণ—মুখো। তার ডান পাশে সরে সরে বসেছে অশোক, সুধীর, অসিত। আর বাঁ পাশে আছে বিনু, অজিতেশ। অজিতেশ পুলিশের ইউনিফরমে এসেছে। অজিতেশের এটা পাগলামি, বিনু এবং অন্যান্যরা এমন ভাবছে। অন্য সময় হলে ওরা এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা করত, কিন্তু খুন—টুনের গন্ধ এর সঙ্গে আছে, তার ওপর অজিতেশ পুলিশের একজন মোটামুটি বড়কর্তা, তাকে অবহেলা করা যায় না। অজিতেশের কথাবার্তায় মনে হয়, ওরা কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। সুতরাং এখন এই অজিতেশ ব্যক্তিটি যা যা করবে, তাতে সায় রাখতে হবে, না থাকলেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, এটা বেশি প্রমাণিত হবে।
আর এ—ছাড়া কী—যে বড় মনে হচ্ছে এখন এই হলঘরটা। নীল আলোতে দেয়ালে মোমের প্লাস্টার বেশি চকচক করছে, দেয়ালে সব ছবি, এবং ছবিগুলো সেই রুপো বাঁধানো ফ্রেমে অবিকল মানুষের মতো হঠাৎ সহবাসের ছবি পরিত্যাগ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা এখন কী বলছে যেন ছবিগুলো শুনতে চায়। আর মাথার ওপরে হলঘরের ছাদটা এত বেশি লম্বা হয়ে গেছে যে মনে হয় দ্রুত বাতাসে লম্বা হয়ে যাবে ছাদটা, এবং ঠিক এই ছাদের শেষ যেন অনেকদূরে এক অন্ধকার নির্জনতায় মিশে গিয়ে নক্ষত্রের দেশে ঢুকে গেছে। ফলে এইসব মানুষগুলোকে টেবিলের পাশে খুব ছোট এবং আকাশের নিচে কোনো সৌরলোক থেকে আসা গ্রহান্তরের মানুষের মতো মনে হচ্ছিল। ওরা টেবিলের চারপাশে বসে রয়েছে। ওদের দেখলে এখন মনে হবে, ওরা কেউ কাউকে চেনে না। ওরা মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে। দেখে মনে হচ্ছিল কোনো মহাকাশযানে ওরা নীল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
কেউ কিছু বলছে না। এ—ভাবে তো চুপচাপ বসে থাকার কথা না। বিনু একবার ঘাড় তুলে তাকাল। সবাই কেমন শোকে মুহ্যমান এমন দেখাচ্ছে। বিনু ফিক করে হেসে দেবে ভাবল, এটা যেন প্রহসনের মতো মনে হচ্ছে, অথবা ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে অলৌকিক উপায়ে মনীষের আত্মা এখানে নিয়ে আসা হবে। অজিতেশ কী পুলিশের কাজ করতে করতে পরলোকচর্চা করে থাকে! বিনুর কেমন সন্দেহ হল। আসলে কী অজিতেশের মনে মনে খারাপ মতলব আছে। সে কী দেখাতে চায়, আর একটা যে খালি চেয়ার রাখা হয়েছে, রাত গভীর হলে চেয়ারটা খালি থাকবে না। সেখানে যে বসে থাকবে, সে মনীষ। মনীষের মুখ দেখা যাবে না হয়তো। ওর অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পাবে সবাই। বিনু ভীষণ ঘাবড়ে গেল। বলল, আমরা এ—ভাবে কতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকব অজিতেশ?