অজিতেশ বলল, সেদিন কফি—হাউসেই প্রথম লোকটাকে দেখে?
সোমা তো তাই বলছে।
আগে কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না!
না। অনেক চেষ্টা করেও পারেনি।
ভারি ইন্টারেস্টিং! সে ফাঁকে ফাঁকে কিছু নোট নিচ্ছিল। সুধীরের ভালো লাগছিল না। যা হবার হয়ে গেছে। এ—সব কেসের কিনারা হয় না। অনর্থক এ—ভাবে বিনু নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।
অজিতেশ বলল, আমার চিঠিটা দরকার।
দেব। বিনু বলল, সোমা নিশ্চয় ওটা তোকে দেবে।
যদি থাকে। সুধীর কথাটা যোগ করল।
থাকবে না কেন?
মনীষ কোথায় রেখেছে, যদি রাখে, যদি সোমাকে না বলে কোথাও রেখে দেয়, অথবা রাগে ছিঁড়ে ফেলতে পারে…এসব হলে সোমা চিঠি দেবে কী করে!
তা ঠিক। অজিতেশ কিছুক্ষণ কী ভাবল।
সুধীর ভাবল, আহাম্মুকি। সে নিজেও জড়িয়ে যাচ্ছে। এ—সব ব্যাপারে যত চুপচাপ থাকা যায় তত মঙ্গল।
অজিতেশ বলল, সোমা সেদিন কী বই দেখেছিল?
বিনু বলল, বোধহয় এ—সময়ের যুব বিদ্রোহের ওপর কোনো বই। বড় পরিচালকের নাম বলে সে বলল, এমনই যেন বলেছিল।
চিঠিটা সম্পর্কে যাতে কোনো ভয় না থাকে সেজন্য বিনু সোমাকে অন্য কথা বলেছে। প্রেমটেমের ব্যাপার অথবা ফাজিল ছোকরার কাজ এমন বলেছে। এখন সে খুব জোর দিয়ে সহজ মনে যা ভেবেছিল তাই বলল। চিঠিটা যে—ভাবেই হোক দিতে হবে অজিতেশের কাছে।
অজিতেশ বলল, দশ তারিখের সকালে তুই ফ্রি আছিস!
সকাল কটায়?
এই নটা নাগাদ।
ফ্রি।
আমার এখানে চলে আয়। এখানে চা খাবি। তারপর তুই আমি সোমার বাড়িতে যাব। আগে থেকে সোমাকে কিছু বলতে হবে না।
দশ তারিখের সকালে বিনু এবং অজিতেশ একটা ট্যাক্সিতে সোমার বাড়িতে হাজির। তখন দশটা বেজে গেছে। সোমা সারা সকাল শুয়ে আছে। বিছানা থেকে উঠছে না। আচমকা বিনু এবং অজিতেশ আসায় সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। সে হেঁটে যাচ্ছে পার্লারের দিকে। রাতে একা ভয়ে ঘুমোতে পারে না অথবা খুব কেঁদেছে, চোখের নিচটা ফুলে গেছে সেজন্য। সে একটা সুন্দর জ্যাকেট গায়ে দিয়েছিল, ওর আসার ভিতরই এমন একটা তন্ময়তা আছে যে অজিতেশ অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকে দেখল। তারপর কেমন সহসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সোমা, তোমাদের শোবার ঘরটা একবার আমার দেখা দরকার।
সোমা বলল, একটু দেরি কর। সে বেল টিপল।
অজিতেশ বলল, এখুনি দেখা দরকার।
সোমা বলল, আমার শোবার ঘরে কিছু বাজে ছবি আছে, ওগুলো মনীষ এনে রেখেছিল, ওগুলো তোমার দেখা ঠিক না।
ওসব অনেক দেখেছি, সয়ে গেছে। ওজন্য ঘাবড়াবার কিছু নেই।
তবু কেমন বে—আব্রু ব্যাপার, এটা বাইরের লোক কেউ দেখুক সে চায় না। শোবার ঘরে এসব ছবি না হলে মনীষের লীলা খেলা জমত না। অজিতেশ ওসব দেখলে টের পাবে মনীষ দত্ত সোমা দত্তকে খুব নিত। সে এটা চায় না বলেই নিজের বোকামির জন্য ভিতরে ভিতরে রেগে যাচ্ছে। এমন একটা শোকের সময় মাথা ঠিক রাখা দায়। মনোরমার উচিত ছিল ছবিগুলো সরিয়ে নেওয়া। পুলিশ যে—কোনো সময় যা কিছু দেখে যেতে পারে। এবং যখন অজিতেশ দেখতে চাইছে, অজিতেশকে খুব ভালো লোক মনে হল না। চালাক ধূর্ত। পুলিশে কাজ করলেই এটা হয়! সে বলল, চল। সে বুঝতে পারল, পৃথিবীতে সে আর কিছু আজ থেকে গোপন রাখতে পারবে না।
শোবার ঘরটা খুবই বড়। বড় হলঘরের মতো ব্যাপার। দুটো বড় খাট। দুটো ছোট মেহগনি কাঠের পুরোনো টেবিল। কাচের বাতিদান। ছাদে ঝুলছে কাচের ঝালর। রকমারি কাঠের কাজ দেয়ালে। এবং মীনা করা দেয়ালের বর্ডার। নীল হলুদ রঙের মেঝে। মনে হয় দামি পাথর বসানো, এবং খুব সন্তর্পণে হাঁটতে হয়। এত মসৃণ মেঝে যে পা সহজেই পিছলে যাবার কথা থাকে। ওরা সন্তর্পণে হাঁটছিল। অজিতেশ নানা কারণে বহু বড়লোকের শোবার ঘর দেখেছে। এতবড় আয়না, মাথা সমান জাপানি ঝালরে ঢাকা আয়না। দুদিকে এমনভাবে স্ক্রীনের মতো বাঁধা যে দড়ি ধরে টান দিলে থিয়েটারের স্ক্রিন উঠে যাবার মতো উঠে যায়। অজিতেশ সেই সিল্কের দড়ি ধরে টান দিল। না এটা স্ক্রিনই। তারপর সে মুখ উঁচু করে দেখল। টেবিলের চকচকে কাঠের উপরে যে সিল্কের ঢাকনা সবই এত দামি যে সে আর দেয়াল দেখার অবকাশ পাচ্ছে না। এবং তারপরই সব ছবি, দেয়ালে অজস্র ছবি। রঙবেরঙের, পৃথিবীর যাবতীয় পুরুষ রমণীর সহবাসের ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি। ছবিগুলো খুব বড় শিল্পীর আঁকা। ন্যুড অথচ কোথায় যে এইসব ছবিতে একটা বিরাট মহত্ত্ব রয়ে গেছে, যার জন্য একসময় অজিতেশ না ভেবে পারল না, মনীষ দত্তের রুচি ছিল।
সে বলল, সোমা তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
সোমা পাশে পাশে হাঁটতে পারছে না, সে ঠিক ঘরের মাঝখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়েছিল। ওর আস্তে কথা অজিতেশ শুনতে পায়নি। কাছে এসে বলল, তোমাকে চিঠিটা দিতে হবে।
কীসের চিঠি?
মনীষকে যে চিঠিতে থ্রেটনিঙ করেছিল।
সোমা বলল, দিচ্ছি।
অজিতেশ বলল, আর একটা কাজ করতে হবে!
কী কাজ!
কাল আমরা সবাই আসব।
বিনু বলল, সবাই বলতে কী বোঝাতে চাইছিস!
সোমার সঙ্গে যারা পরিচিত তারা সবাই। কিছু হিল্লে করা যায় কিনা। জটিল ব্যাপার। মনীষ ভয় পেয়ে পাগল হয়ে যেত। পাগল যে হয়ে যায়নি তাই বা কে বলবে! সেজন্য ওর আত্মহত্যা করা স্বাভাবিক। যাই হোক। আমরা সবাই। আমি, বিনু, সুধীর, অশোক, অসিতবাবু এবং তুমি। বড় টেবিলটা থেকে আয়না খুলে নেবে। সাতটা চেয়ার। ঘরে আর কিছু থাকবে না।
ষোলো
সোমা পরদিন ফোন করে বলল, অজিতেশ আছে।