এবং এ—সময়ে বিনু দেখল, দুজন অফিসার, সে একজনকে চেনে মনে হল। কিন্তু এইসব পোশাকে সঠিক বোঝা যায় না। সে সাহস পেল না কিছু বলতে। অফিসারটিই বলল, তুই বিনয় না। আমাদের ক্লাসের বিনু। আমি তোদের সবাইকে চিনি।
বিনু বলল, আমিও চিনি। লাশটা তোর….
অজিতেশ বলল, তোরা কার লাশ দেখতে এসেছিস! সে খুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
মনীষের।
মানে মনীষ দত্ত।
মনীষ দত্ত মানে সোমা গাঙ্গুলীর স্বামী।
হ্যাঁ।
লাশ মনীষ দত্তের! দেখতে হয়! আমি তো আর দশটা লাশের মতোই চটের থলে দিয়ে বেঁধে রাখতে বলেছি। খুব আগলি সিন হবে। সোমা কী সহ্য করতে পারবে!
তুই দেখিসনি!
ভোর রাতে এসেছে। এখনও যাইনি। দেখে লাভ নেই! মরা মানুষ দেখতে ভালো লাগে না। তবু দেখতে হয়। কাজকর্ম চালাতে হলে কাজ করতেই হয়। সোমা কোথায়।
পাশের ঘরে আছে।
অজিতেশ ওর জুনিয়র অফিসারকে ডেকে বলল, হোমরাজকে ডেকে পাঠান।
হোমরাজ এলে বলল, রঘুবাবুকে বল একটা সাদা চাদর দিতে। আর তুই দেখবি, লাশের মুখটা শুধু যেন বের করা থাকে। যেন শুয়ে আছে মতো। চাদরটা ভালোভাবে গুঁজে রাখবি। বাতাসে উড়ে—টুড়ে গেলে নাড়ি—ভুঁড়ি দেখে ফেললে আর একটা দুর্ঘটনা হতে পারে। বুঝলি, অজিতেশ বিনুর দিকে তাকিয়ে বলল, পেটের ভিতর যে এতসব নিয়ে আমরা ঘোরাফেরা করি বুঝতে পারি না। ট্রেনে কাটা লাশ—টাস দেখলে এটা হয়। নিয়ম একেবারে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া। অথবা মর্গে। তবে বড়লোকের ব্যাপার তো। সোজা এখানেই।
অশোক দেখল, দূরে করিডোরে বিনু কার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ওরা এলে বিনু ওদের পরিচয় করিয়ে দিল। চিনতে পারছিস তো!
খুব। অশোক বলল।
সুধীর বলল, তুই যে আমাদের মনে রেখেছিস!
আরে যা! আয় চা খাবি।
বিনু বলল, সোমার সঙ্গে পরিচয় করবি না?
অজিতেশ বলল, না। সোমা এখন নিজের ভেতর নেই। খুব খারাপ লাগছে সোমার জন্য। বলেই অজিতেশ তিনজনের দিকেই তাকাল, তোদের কী মনে হয়?
বিনু বুঝতে না পেরে বলল, কী ব্যাপারে!
এই যে মনীষ ট্রেনে কাটা পড়ল, আসলে এটা আত্মহত্যা না খুন না অন্য কিছু!
সে তো তোরা বলতে পারবি।
অজিতেশ হাসতে হাসতে বলল, অনেক সময় পুলিশের চেয়ে যারা চারপাশে থাকে তারা ভালো জানে। তারা ভালো বলতে পারে।
সুধীর মনে মনে গজগজ করতে থাকল। এবারে ঠ্যালা সামলাও।
অজিতেশ বলল, আয়। আমার এটা ঘর। এখানে বসি, কোনো অসুবিধা হলে বলবি। একটু চা খা। ওদিকে ঠিকঠাক করুক; তারপর আমরা একসঙ্গে যাব।
ওরা তারপর একসঙ্গে বের হল। সোমাকে নিয়ে যাওয়া হল। সরু মতো গলি। দুদিকে উঁচু বাড়ি, এবং অন্ধকার মতো জায়গায় শ্যাওলা ধরা মতো ঘরের তালা খুলে ফেলা হল। অন্ধকার ঘর। দিনের বেলাতেও আলো আসে না। একটা আলো জ্বেলে দেওয়া হল। হোমরাজ কোর্তা পরে আছে। ছেঁড়া পেন্টালুন। কালো লম্বা দস্যুর মতো মানুষ। ছেঁড়া চটি এবং চুল রুক্ষ, কোঁকড়ানো, মাথাটা ফেট্টি বাঁধা। লম্বা গোঁফ দু গালে ঝুলে পড়েছে। দেখলেই মনে হবে জ্যান্ত যম, যমের মতো পাহারাদার লাশকাটা ঘরে। সে বলল, এই যে বাবু। ওই যে মেমসাব। স্যার দেখুন কী চোখ মুখ। গোটা শরীর চাদরে ঢাকা চটে বাঁধা এখন নেই। খোলামেলা। কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না কেউ। মনোরমা ধরে রেখেছে সোমাকে। সোমা উপুড় হয়ে পড়ে যেতে পারে। চারপাশে ওরা পাহারাদারের মতো। যেন সোমা উপুড় হয়ে পড়লেই কে পড়তে দিচ্ছে। সোমা দেখে হাহাকার করে উঠল।
ব্যাস হয়ে গেছে। এই তবে মনীষ দত্ত। এখন আর কিছু করণীয় নেই। পুলিশের করণীয় কাজ আছে তারপরও। তারপর মর্গে। মর্গ থেকে খালাস পেতে আরও সময়। ওরা এখন ফিরে যাবে।
বিনু বলল, পুলিশ কিনারা করতে পারবে কিছু।
অজিতেশ বলল, পুলিশের পক্ষে আমারই তদন্ত করার ভার। তবে পুলিশ কিছু করতে পারবে না। এখন তো হামেশা এ—সব হচ্ছে।
তার মানে! আমাদের বন্ধু। তুই ওকে চিনতিস। তুই একটা এর কিনারা করতে পারবি না।
হয় না। কিনারা হয় না। তবে চেষ্টা করা হবে।
বিনু, সোমাকে নিয়ে চলে যেতে বলল অশোককে। সুধীর বিনুর সঙ্গে থাকবে। অজিতেশের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে যেতে হবে।
এবং কথাবার্তা হওয়ার পর অজিতেশ বলল, আমাদের একদিন বসতে হবে। তুই যা যা বললি শুনলাম। দুটো চোখ সোমাকে বিভ্রান্ত করছে। দু—একদিন না গেলে সোমাকে কিছু বলা যাবে না। এখন সোমা ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারবে না। সময় দিতে হবে। এমনকী একটা রহস্য আছে বুঝতে পারিনি। আচ্ছা চিঠিটা পাওয়া যাবে তো।
কোন চিঠিটা?
ঐ যে মনীষকে ভয় দেখিয়ে একটা লাল কালিতে চিঠি দিয়েছিল।
অঃ। কিন্তু ওটা তো সাদা চোখেই বোঝা যায় ছেলেছোকরাদের কাজ। দেশ উদ্ধার করবে বলে যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের কাজ।
অজিতেশ ওর চেয়ারে বসে একটা চুরুট টানছিল। ওর টেবিলটা ভীষণ বড়। এ—পাশে শুধু বিনু আর সুধীর বসে রয়েছে। করিডোরে পুলিশের বুটের শব্দ। মাঝে মাঝে সৈন্য—সামন্ত নিয়ে ফিরে আসার মতো পুলিশের গাড়ি ফিরে আসছে। অজিতেশ কাগজে কী সব লিখে দিচ্ছে, আর আবার গাড়ি উধাও হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একজন ছোটোখাটো অফিসার ঢুকে নির্দেশ নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে কথাবার্তা চালাচ্ছে ওরা। মনীষের মৃতদেহ এখন চটের ভিতর পুরে হোমরাজ একটা ভাঙা হাতল গাড়িতে ঠেলেঠুলে তুলে দিচ্ছে। এর পাকস্থলী বের হয়ে পড়েছে। সেটা ঠেলেঠুলে একপাশে রেখে দিচ্ছে আর তখন সোমা যাচ্ছে গাড়িতে। ওর মুখে রক্তশূন্যতা, বিবর্ণ, চুলে আর বাহার নেই। একদিনেই তাকে অনেক বয়স্ক করে দিয়েছে।