ও—পাশ থেকে কথা বলার আগ্রহ ছিল, কিন্তু বিনুর এক ধমক। —যা বলছি কর। এসে সব শুনতে পাবি।
অশোক বের হয়ে সুধীরের খোঁজে গেল। সুধীর সকালে বাড়ি থাকে না। রোববার, বাড়ি না থাকারই কথা। সকালের দিকে ক্লাবে আড্ডা দেবার স্বভাব। ক্লাবে গিয়ে দেখল সেখানেও নেই। ক্লাবের একটা ছেলে বলল, বীরেনবাবুদের বাড়িতে গেছে। ও—পাশের গলিতে ঢুকে একটা নীল রঙের সাইনবোর্ড দেখবেন, তার পাশের বাড়িটা বীরেনবাবুদের। এবং এ—ভাবে, অশোক ঠিকঠাক পেয়ে গেল সুধীরকে। সুধীরকে সে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে পড়ল। কিছু বলছে না, সুধীর সব শুনলে নাও যেতে পারে। ও যা স্বভাবের মানুষ! কিন্তু সোমার এমন বিপদে সে স্থির থাকতে পারছে না। সোমার বিয়ের পর মনে মনে সে সোমা অসুখী হোক চাইছিল, মনীষের কিছু একটা হয়ে যাক, কিছু একটা হয়ে গেলে, সোমা ওর কাছে আবার ঘুর ঘুর করতে পারে অথবা অসম্মান করে সোমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে, কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর সে নিজেই ভারি দুঃখী লোক হয়ে গেছে! আসলে বিপদটা তার নিজের যেন। সে ট্যাক্সিতে উঠে বলল, মনীষ খুন হয়েছে!
সুধীর বলল, কী বলছিস যা তা!
সত্যি বলছি।
কোথায় খুন হয়েছে!
জানি না।
কখন খুন হয়েছে!
জানি না। বিনু সোমাদের বাড়িতে। সে তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।
সুধীর বলল, আমি এ—সব খুন—টুনের সঙ্গে জড়াতে চাই না। আমাকে নামিয়ে দে। ও—সব আমার সহ্য হয় না। সহসা খুন—টুন ভালো ব্যাপার নয় এমন বুঝে বলে ফেলল।
অশোক বলল, তুই কী বলছিস!
সুধীর বলল, আগে বলবি তো। দিনকাল যা যাচ্ছে, এখন এ—সবে কেউ মাথা গলায়!
সোমার কথা ভাব!
ধুস সোমা। বড়লোক খুন—টুন হবে বেশি কী! সোমা আবার একটা বিয়ে করে নেবে। আমাকে ছাড়, আমি যাব না।
অশোক বলল ঠিক আছে। তুই নেমে যা। আমাকে যেতেই হবে।
এবং ট্যাক্সি কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে থামলে অশোক বলল, বিনু একা সব দিক সামলাতে পারবে না, বোধহয় এ—জন্য তোকে নিয়ে যেতে বলেছিল।
সুধীর কী ভাবল। এ—ভাবে নেমে যাওয়াও যেন ঠিক হচ্ছে না। অশোকের ওপর রাগ হচ্ছিল খুব। খুন—টুনের ব্যাপারে জড়ালে শেষ পর্যন্ত কী হয় তার জানা আছে। কার দায় কোথায় গড়ায় কে জানে। ওর এ—ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞতা হয়েছে। রাস্তায় কে মেরে গেল, আর কেউ রাস্তা ধরে চলে গেল, পুলিশ তাকেই তুলে নিল, সে একবার এ—ভাবে থানায় চলে গিয়েছিল। তার মা বাবা থেকে চোদ্দ গুষ্টির কথা জেনে ছেড়েছিল। মারধোর করেনি এই যা রক্ষে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে ভেবে ফেলে, অশোক এবং বিনু যাচ্ছে, অশোক ঠিক বিনুকে বলবে, বিনু ভাববে, সুধীর কাপুরুষ, সোমা হয়তো কোনোদিন তার কথা আর ভাববে না। সোমার কথা ভেবে বলল, চল।
অশোক বলল, অসুবিধা হলে থাক।
সুধীর বলল, বুঝিস না কেন? আমরা ছা—পোষা লোক। কোর্ট—কাছারি করতে পারি না।
এখানে কোর্ট—কাছারির কী হল!
ট্যাক্সি যাচ্ছে। একটু জোরে চালাতে বলেছে অশোক। এবং সুধীর শেষ পর্যন্ত কিন্তু বরং অশোকের চেয়ে বেশি করিতকর্মা মানুষ হিসেবে প্রায় সোমাদের বিশাল বাড়ির সদর দরজায় নেমে একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে ঢুকে গেল। কোর্ট—কাছারি কথাটা তার মনে থাকল না। এবং নিঝুম এই বাড়িতে পুলিশের এক গাড়ি। কালো রঙের পুলিশের গাড়ি। মৃতদেহ শনাক্ত করার কথা। মনীষের ব্যবহারিক সব, এই যেমন সুটকেস, মানি ব্যাগ ডাইরি সব দেখানো হচ্ছে। সোমা সকাল বেলাটায় বোধহয় সংজ্ঞা হারানো অবস্থায় কাটিয়েছে। এখনও ঠিক হুঁশ নেই তার। তবু দেখে দেখে বুঝে নিচ্ছে সবই মনীষের, তারপর ওদের যেতে হবে গাড়িতে। দুটো গাড়ি বিনু ঠিকঠাক করতে বলেছে। একটা গাড়িতে অশোক, সুধীর এবং অসিতবাবু। একটা গাড়িতে মনোরমা, রসুল, বিনু, সোমা। সামনে পুলিশের গাড়ি। এবং শীতের সকালে রোদ বেশ, ছুটির দিন বলে চৌরঙ্গি পাড়ায় ভিড় নেই। সকালে সব ছেলেমেয়েরা নিত্যদিনের মতো খেলা করছে। এবং গাছে গাছে তেমনি বাতাস, আর সেই বুড়ো লোকটা আগুন জ্বেলে ঠিক বসে রয়েছে। পুলিশের রিপোর্টে তার সব বর্ণনা থাকবে। সোমাকে সবই খুলে বলতে হবে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।
কখনও মনে হয় ওরা মিছিল করে যাচ্ছে। আগে পুলিশের গাড়ি, পরে সোমাদের গাড়ি, পেছনে অশোকদের গাড়ি। ওদের দুটো গাড়িই দামি। বড়লোক খুন—টুন হলে এমনি হয়ে থাকে। অবশ্য পুলিশ থেকে এটা খুনের ঘটনা বলতে পারছে না। আবার আত্মহত্যার ঘটনাও বলতে পারছে না। ট্রেনে কাটাও বলতে পারছে না। ট্রেনে কাটা পড়েছে। প্রথম শ্রেণীর রিজারভেশান দূরপাল্লার গাড়ি। এবং ব্যান্ডেল ছাড়তে না ছাড়তেই ঠিক মগরার গুমটি ঘরের কাছে লাশ পাওয়া গেছে। তার যেহেতু পকেটে ছোট্ট ডাইরি ছিল, খোঁজখবর নিতে সময় লাগেনি। মনীষ দত্ত যে মর্গে চালান যাবে এবং লাশের পাশে ডোম হোমরাজ সাহনি দাঁড়িয়ে আছে, পুলিশের গাড়িতে কাক, এ—সব বিনু সোমার মুখ দেখতে দেখতে মনে করতে পারল। সোমাকে সে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে।
ওরা বেশ বড় বাড়িটার সদর গেটে ঢুকে গেল। তারপর আরও ভিতরে। একদল পুলিশ দূরের মাঠে প্যারেড করছে, ঠিক প্যারেড না করলেও প্যারেডের মতো মনে হয়, কারণ ওরা প্যারেড করে বের হয়ে গেছে। এবং গাড়িতে একদল সাদা ইউনিফর্ম পরা পুলিশ বের হয়ে গেল, আর মোটর বাইকের শব্দ, সার্জেন্ট, সাব—ইন্সপেক্টর এবং আরও বড় অফিসারদের ওরা দেখতে পেল করিডোর দিয়ে যাচ্ছে! ওদের গাড়ি এবং সোমাকে দেখেই পুলিশের চোখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ওরা বুঝতে পারছে একজন বড়লোকের বউ এসেছে স্বামীকে শনাক্ত করতে। ওরা যে যার সিটে অথবা গাড়িতে বসে থাকতে পারছিল না। খুন—টুন হওয়া মানুষের বউ এত লম্বা এবং চাকচিক্যময় অথবা সুন্দরী হতে নেই।