তুই এটা কী বলিস! ওঁর মতো পরিচালকের কাছে সেটা কেউ আশা করে না। ওরা নিশ্চয়ই ওঁর ছবি দেখতে ভালোবাসে বলেই এসেছে।
সোমা বলল, বের হয়ে দেখি তিন যুবক আর এক যুবকের কলার চেপে ধরেছে। বলছে, বোঝাও কী দেখলে। একজন বলল, শালা তুমি আমাদের সিডিউস করছ। তুমি না বললে আমরা আসতাম না।
মানে! বিনু বলল।
মানে জানি না। সোমা বলল, দেখলাম, সে আমতা আমতা করে তার তিন বন্ধুকে বোঝাচ্ছে, আজকের দিনের কত বড় সমস্যা তিনি এই সামান্য সময়ের ভিতর তুলে ধরেছেন। প্রায় গীতিকাব্যের শামিল।
এ—ভাবে বই শেষ হয়! আজকের দিনের সমস্যা গীতিকাব্যের মতো!
হয় না?
ধুস শালা! তুমি বোঝ না কিছু, তুমি জান না ওর ডিউপার্ট আছে। ওটা পরে দেখানো হবে। বলে সেই বন্ধুর হাসি নকল করতে চাইল সোমা।
মনীষ সোমার কথায় কেমন ছোট হয়ে গেল। বলল, মুশকিল কী জানিস, এ—দেশের মানুষের একটা স্বভাব আছে, সে স্বভাবটা হচ্ছে যা বুঝি না তাই বোঝার ভান করি।
সোমা বলল, তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে বল।
আমি নিজের দিকে তাকিয়েই বলছি, ফিল্ম ওয়ার্লডে এটা রেভলিউশান।
বিনু বলল, আমি দেখেছি। আমার কিন্তু অন্য কথা মনে হয়েছে।
মনীষ ব্যাগ খুলে টাকা গুনছিল। সে না তাকিয়েই বলল, কী মনে হয়েছে?
তোমরা ব্লো—আপ দেখেছ কেউ?
অশোক বলল, আমি দেখেছি।
বিনু বলল, বইটা এলে তোমরা সবাই দেখো। তারপর আবার আলোচনায় বসা যাবে।
মনীষ বুঝল বিনু এ—ব্যাপারে আর এগুবে না। বিনু বাজে তর্ক করেও না, করতে ভালোও বাসে না।
মনীষ বলল, তবু তোরা সবাই দেখিস। না দেখলে বড় কিছু একটা মিস করবি।
আবদুল টাকার চেঞ্জ ফিরিয়ে দিল। সে বিশটা পয়সা রেখে বাকি সব তুলে সোমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে এমন ভাবতেই দেখল, দূরের টেবিলে সোমা কাকে দেখছে। প্রায় চুরি করে দেখার মতো।
মনীষের এটা ভালো লাগল না। সোমা যে ধরা পড়ে গেছে সে তার আচরণে এমন কিছু প্রকাশ করল না। সে শুধু বলল, আমরা যাচ্ছি!
দুই
কে এই মানুষ! প্রশ্নটা দুজনের মনেই উঁকি দিয়েছে। সোমার ভিতর নানাভাবে দূরের স্মৃতি উঁকি দিয়ে যাচ্ছে আর মনীষ ভেবেছে সোমা তার কাছে লুকোবার চেষ্টা করছে। টেবিল থেকে উঠে পড়ার সময় সে দেখেছে সোমা এবং সেই মানুষটি কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে ছিল। ধরা পড়ে যাবার ভয়টুকু পর্যন্ত সোমার প্রাণে ছিল না।
ফলে ওরা যখন সিঁড়ি ধরে নামছিল, তখন কেউ কথা বলেনি। চুপচাপ নেমে গেছে। সোমা ভেবেছে মনীষ কথা বলছে না কারণ ওরা পরস্পর ভিন্ন মত পোষণ করছে বই সম্পর্কে। এবং সোমা ওকে ছোট করার জন্য সব বলে দিয়েছে, এমনকি নিজের ভালো না লাগার ব্যাপারও জানিয়ে এসেছে, এসব কারণে মনীষ ওর ওপর রাগ করতে পারে। তবে সে মনীষের এই রাগ অথবা অভিমান মুহূর্তে ভেঙে দিতে পারে, তার হাতে জাদুর কাঠি, সে শুধু দু’দিন শরীর খারাপ যাচ্ছে, কিছু ভালো লাগছে না বলে গলায় র্যাপার জড়িয়ে শুয়ে থাকবে। তখনই মনীষের মুখ বড় কাতর। সে কেমন শিশুর মতো মুখ করে রাখে। সে কাছে এসে বসবে। মাথায় হাত বুলাবে। আদর করতে চাইবে। তারপর সেই এক জায়গায় চলে যাওয়া। সে হাত দিতে দিতে যখন জায়গামতো চলে যাবে তখনই বলা—আমার শরীর ভালো নেই, আমি পারব না মনীষ। আমাকে তুমি আর কষ্ট দিও না। এবং তারপরই মনীষের পালা। কী করে এই মেয়ে সোমা যার চোখ বড়, যার লাবণ্য শরীরে বাড়ে দিনে দিনে, যে না হলে তার রাতের জলপান হয় না, সে তৃষ্ণার্ত থাকে। কী নরম আর পুষ্ট বাহু সোমার। সে সোমার শরীরে হাত রাখার জন্য পৃথিবীর যাবতীয় ঐশ্বর্য তখন চুরি করে আনতে পারে। সুতরাং মনীষ যে কথা বলছে না, মনে মনে সোমার ওপর চটে গেছে, সেজন্য তাকে সোমা আদৌ আমল দিল না। সোমা চুপচাপ পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে, সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে এবং গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেছে।
বেশ শীতের ঠান্ডা। ক’দিন আগে ঝড়—বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ওরা শীত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। ভিতরে ঠান্ডা ঢুকছে। মনীষ ওপাশের দরজায় কাচ তুলে দিলে। এবং নিজের দিকের কাচ তুলে চুপচাপ একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলল।
হঠাৎ সোমা একটা ওকের মতো তুলে আর একটু সরে বসল। সে জানে এই ওক দেওয়া মনীষকে উদ্বিগ্ন করে তুলবে। সে বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে না। সোমা আবার একটু বড় ঢেঁকুর তুলে কেমন কষ্টবোধের ভান করল। এবং সে যেন এখন কিছুই দেখছে না শুধু শহরের ট্রাম—বাস দেখছে। ওদের গাড়ি গড়ের মাঠ পার হয়ে চলে যাচ্ছে। বোধহয় শীতের জ্যোৎস্না মাঠে। এমন জ্যোৎস্নায় আর কেউ বুঝি আজকাল এই মাঠে প্রেম করতে আসে না। সোমার ইচ্ছা হল, বলে, আমরা কতবার এসেছি এখানে, গঙ্গার জেটিতে গিয়ে বসেছি। ফোর্ট উইলিয়ামের র্যামপার্টে। সে—সব তোমার মনে পড়ে মনীষ? কিন্তু মনীষ উলটোমুখে গাড়ি—ঘোড়া এবং যে—সব বেশ্যা রমণীরা বের হয়েছে মাঠে খদ্দেরের আশায় তাদের দেখছে। সোমা আবার একটা গলা—জ্বালা ছেঁকুর তুলে ভীষণ কষ্টবোধে কাতর হচ্ছে এমন চোখ—মুখ করে রাখল।
মনীষ আর পারল না। তোমার কী প্যাটিস খেয়ে অম্বল হয়েছে?
না।
তবে এমন ঢেঁকুর উঠছে কেন?
কী করে বলব বল?
কোনো কষ্ট হচ্ছে?
বুকটা কেমন করছে।
জ্বালা জ্বালা করছে না তো?
ঠিক জ্বালা জ্বালা না। কেমন ধড়ফড় করছে।