বুঝতে পারছি না। বলে সোমা তার চাদর দিয়ে শরীর যেন আরও ঢেকে দিল। পুবের বারান্দার মতো ছাদের এ অংশটা। বেশ শীতের রোদে ওরা দুজনই বেশ উষ্ণতা ভোগ করছে। কারও এখন বিশেষ শীত করছে না। সোমা বলল, অবাক!
অবাক হবার কিছু নেই। তুমি বাড়ি নেই, মনীষ ভয়ে কাতর, রামঅবতার অথবা তোমাদের মালিদের কেউ সে—সময় মনোরমার ঘরে যায়নি এবং তোমার ফিরে আসার খবর পেয়ে বের হয়ে আসেনি, গাড়ি বারান্দায় একপাশে অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে নিজেকে গোপন করেনি কে বলবে।
সোমা কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারেনি। হতে পারে। এমন একটা ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে কেউ স্বীকার করবে না বুঝতে পারে। সে বলল, তবে সেই বাথরুমে….।
বাথরুমে মানে!
বাথরুমের আয়নায় দেখলাম, ঠিক সেই চোখ দুটো, আমি যেমন যেমন ভাবে অঞ্জনকে ভেবেছি, ঠিক হুবহু সেই মানুষটা আয়নায় দাঁড়িয়েছিল।
তা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বইকি!
এবারে সোমা ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। সে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ ঝুঁকে বলল, দাঁড়িয়ে থাকতে পারে মানে! কী বলছিস সব!
তুই ভীষণ উত্তেজিত সোমা। তোর মাথায় সবসময় সেই চোখদুটো, সেই মানুষের হুবহু ছবি চলাফেরা করছে। তোর একটা ইলিউসান দেখা অস্বাভাবিক না।
সোমা বলল, তুমি কি আমাকে গ্রাম্য বালিকা ভেবেছ বিনু! তুমি কী বলতে চাও বুঝি না। ওরা এখন তুমি তুমি করে কথা বলছে। গুরুত্বপূর্ণ কথার সময় এটা বোধহয় হয়।
আসলে সোমা, এবার বিনুও উঠে দাঁড়াল, আমরা সবাই শৈশবে নানাভাবে স্বপ্ন দেখে থাকি। তোমার শৈশবেও স্বপ্ন ছিল। সব মানুষের স্বপ্ন এক রকমের থাকে না। তোমার শৈশবে কী স্বপ্ন ছিল বললে, ব্যাপারটা আরও সহজ করে বোঝানো যেতে পারে।
শৈশবে আমি একটা প্রতিশোধের কথা ভাবতাম কেবল। বাবার আত্মহত্যার কথা মনে হলেই এটা মনে আসত।
বিনু বলল, তোমার বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন!
সোমা এমন গোপন পারিবারিক কথা এত অনায়াসে বলে ফেলে অবাক। কেউ জানে না, কেবল শৈশবে সেই দুঃখের দিনে যারা তার চারপাশে ছিল ওরা জানত। সে যে বিনুকে কোনোদিন কথাটা বলেনি, কেবল বিনু কেন, মনীষও জানে না, সেই আত্মহত্যারখবর, তার মা একজন ধনী ব্যক্তির রক্ষিতা, এ—সব খবর সে কাউকে বলেনি, বলেছে বলে অন্তত এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না, সে বলল, বিনু তুমি যখন সব জেনেছ এটা না জানলে বাকিটুকু বুঝতে পারবে না। আসলে বাবা আমার খুব দুঃখী লোক ছিল। মা ছিলেন ভীষণ সুন্দরী এবং বাবার আত্মহত্যার মূল কারণ ছিল সেই ধনী ব্যক্তির লোভ এবং মার নিদারুণ অসহায় মনোভাব। তুমি জানো না হয়তো আমার মাকে পাবার জন্য নানাভাবে একটা সামাজিক চাপ ছিল বাবার প্রতি। সেই অসাম্য চাপের বিরুদ্ধে আমার ভীষণ বিদ্রোহ ছিল। আমি চাইছিলাম কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে, সে আমার সঙ্গে একটা জয়েন্ট কমান্ডো তৈরি করবে। একজন সৎ মানুষের কথা সবসময়ই ভাবতাম। এবং মনে হত, সেই মানুষ আমাকে বারবার বলেছে, তুমি সোমা কাজল পর না। আমি এতদিনে মনে করতে পারছি কে আমার মনের মানুষ। কাজল পরলে সঠিকভাবে পৃথিবীকে চেনা যায় না। বলতে বলতে সোমা কেমন হাঁপিয়ে উঠল। সে আর বোধহয় দাঁড়াতে পারছিল না। সে সোফাতে নিদারুণ দুঃখী যুবতীর মতো বসে থাকল। মাথার ওপর এতবড় আকাশ রয়েছে, শীতের সময় বলে বাগানে কত রক্ত—গোলাপ, আর চারপাশে নিরিবিলি সব গাছপালার ভিতর এক আশ্চর্য মহিমা আছে সে বুঝতে পারছে না।
বিনু বলল, তাহলে তোমার নিজের কথাতেই আসা যাক। তুমি এ—ভাবে একজন মনের মানুষ চেয়েছিলে পাওনি। বরং উলটো এমন একজন তোমার কাছে হাজির যাকে তুমি চাওনি। বলে একটু থামল। কী ভাবল।—আচ্ছা সেদিন যাকে বাথরুমে দেখেছিলে সে দেখতে কেমন।
ভারি সুন্দর।
তুমি সোমা এমন একজন মানুষকেই চেয়েছিলে সঙ্গে। কিন্তু মানুষের দোষ কতভাবে যে থাকে। তাকে তুমি পাওনি, না পেয়ে ভালোই হয়েছে। পেলে তার দাম থাকত না। সারাদিন তুমি তবে আরও একাকী থাকতে। সে একাকিত্ব আরও মারাত্মক।
সোমা কিছুক্ষণ কথা না বলে একটু নিজের ভিতর ফিরে আসতে পেরে বলল, তবে চিঠিটা!
চিঠিটার কথা তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি ভয় পাইয়ে দেওয়া।
তবে তুমি বলছ, এই যে হত্যাকাণ্ড সব ঘটছে এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
আমার মনে হচ্ছে, না।
আর ঠিক সে—সময়ই ফোনে কে যেন সোমাকে চাইছে।
সোমা উঠে গিয়ে ফোনে কী শুনতে শুনতে টেবিলে মূর্ছা গেল। বিনু ছুটে গেল টেবিলের কাছে। সে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল, কে? সোমা টেবিলের ওপরই পড়ে আছে। সে ফের বলল, হ্যালো, কে বলছেন! এবং সে বুঝতে পারল পুলিশ অফিস থেকে ফোন। কেউ যেন বলছে, মনীশ দত্তের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, আপনি কে!
সে বলল, মনীশ দত্তের স্ত্রী মূর্ছা গেছে।
তবে শুনুন। একটা লাশ পাওয়া গেছে। ব্যান্ডেলের কাছে রেললাইনের ধারে পাওয়া গেছে। ওর ডায়রি থেকে সব খবর জেনে ফোন করছি।
বিনুর হাত কাঁপছিল। সেও বোধহয় মূর্ছা যেত। সে বলল, আপনাদের ঠিকানা!
লালবাজার, স্পেশাল স্কোয়াডে খবর নেবেন।
বিনু এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। সে প্রথমে সোমাকে খাটে শুইয়ে দিয়ে চিৎকার করে ডাকল, রসুল! মনোরমা!
পনেরো
বিনু প্রথমে অশোককে ফোন করে বলল, সুধীরকে নিয়ে শিগগির চলে আয়। সোমাদের বাড়িতে চলে আয়। মনীষ খুন হয়েছে।