সোমা ভাবল বলবে কী বলবে না। কিন্তু একজনকে তো বলতেই হবে। বিনু বাদে তার এ—মুহূর্তে নিজের কে আছে! বিনু অথবা অসিতবাবুর পরামর্শমতো চলা দরকার। পুলিশে খবর দিতে হবে কিনা তাও পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। অসিতবাবু মনীষের বন্ধু। মনীষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি। ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কম। মানুষটাকে মনীষ যত জানে, সে ঠিক ততটা জানে না। বরং বিনুকে সোমা অসিতের চেয়ে ভালো জানে। বিনু কখনও অপকার করতে পারে না। তাকেই সব খুলে বলা যেতে পারে।
বিনু বলল, সেই লোকটার খবর পেলি!
সোমার যেন খুব শীত করছে। সে চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল। কিন্তু তাতেও শীত যাচ্ছে না। সে বলল, বিনু আয় আমরা সামনের করিডোর পার হয়ে পুবের ছাদে গিয়ে বসি। সেখানে বোধহয় এতক্ষণে রোদ এসে গেছে।
সোমা এবং বিনু সোমার শোবার ঘর অতিক্রম করে ছাদে চলে এল। এতবড় শোবার ঘর কেউ ব্যবহার করে পৃথিবীতে! এবং এমন সব ছবি, ছবিগুলো সব অদ্ভুত ধরনের, ছবিগুলো সব ন্যুড এবং ছবিগুলো দেখলে মাথায় রক্ত উঠে আসে অথবা এক লহমায় উত্তেজনা। এ—সব ছবি দেখলে তো মানুষের ভেতর এমনিতেই সবসময় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার কথা, ওরই তো শরীর কেমন করছে, অথচ সোমা নির্বিকার! যেন ওতে কিছু নেই। ব্যবহারে ব্যবহারে সোমা কিছুটা ভোঁতা হয়ে গিয়ে থাকবে! তা না হলে, সোমা কিছুতেই এ—ভাবে এখানে নিয়ে আসতে পারত না। অথবা মনীষের জন্য মাথা ঠিক নেই। ওর খেয়ালই নেই, এ—ঘরে পৃথিবীর দুজন মানুষ ঢুকতে পারে, মনীষ দত্ত এবং সোমা দত্ত তাদের নাম। আর ঢুকতে পারে মনোরমা।
সোমা বলল, পেলাম না।
বিনু বলল, আসলে তোর মনের ভুল এটা।
এখন আমারও মনে হয়।
তুই কাউকে ও—ভাবে জানিস না।
কিন্তু চোখ দুটো যে বড় চেনা!
তাই হয়। আসলে কী জানিস! বলে বিনু বেতের চেয়ারে বেশ আরামে হেলান দিল। চাদর ভালো করে জড়িয়ে নিল শরীরে। সামনে একটি টিপয়। সাদা ঝালরে ঢাকা এবং মীনা করা, মনে হয় হাতির দাঁতের কারুকার্য আছে ওতে। সে চায়ে চুমুক দিল।
সোমা চায়ে চুমুক দিল না। হাতে নিয়ে বসে থাকল। আসলে কী জানিস—তারপর বিনু কী বলবে শোনার প্রতীক্ষাতে সে উদগ্রীব। বিনু কিছু না বলা পর্যন্ত সে চা খেতে পারছে না।
বিনু বলল, আসলে কী জানিস, আমরা মনে মনে যা ভাবি তা পাই না।
সোমা বলল, মানে!
মানে এই দ্যাখ না, কত আশা ছিল আমার। পৃথিবী জয় করব আশা ছিল, কিন্তু হল কোথায়! এখনও কিন্তু ভাবি, ঘরে ফিরেই একটা চিঠি পাব। মনে হয় কেউ আমাকে একটা চিঠি দেবে, তা পেয়ে আমি আঁৎকে উঠব, এবং সেখানে আমার রাজ্য জয়ের খবর থাকবে। প্রতিদিন এভাবে কেটে যাচ্ছে, চিঠি আসছে না, তবু রোজ ভাবি চিঠি আজ হোক কাল হোক আসবে।
সোমার এতসব কথা ভালো লাগছিল না। সে সোজা বুঝতে চাইছিল। রহস্যটা কোথায়! কিন্তু বিনু এমনভাবে নিজের কথা বলছে যে, সে যেন তার নিজের কথা শোনাতে এসেছে এখানে। সোমার যে এমন একটা বিপদ তা আমলই দিচ্ছে না। মনীষের এটা ছেলেমানুষী ভাবছে। সেও কথার পিঠে কথায় সায় দিয়ে গেছে, ছেলেমানুষী বলে। কিন্তু পর পর যা ঘটনা একে একে ঘটে গেছে, এবং যেভাবে ওরা ক্রমে অস্থির হয়ে উঠেছিল, তাতে যে—কোনো মানুষের পক্ষে পাগল হয়ে যাওয়া সম্ভব। সে বলল, তোকে সব বলিনি বিনু। শুনলে কিন্তু আর সমাধান খুঁজে পাবি না।
বিনু বলল, সমাধান নেই এমন ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে না। বলে কেমন দার্শনিক চোখে তাকিয়ে থাকল বিনু।
সোমা তারপর সব ঘটনা খুলে বলে একে একে প্রশ্ন করে গেল, চিঠিটার ব্যাপারে কী মনে হয়!
বিনু বলল, চিঠির ব্যাপারে তোকে আগেও বলেছি।
সবই এত সরল তুই ভাবিস! এত সহজে সমাধান! সোমা ভাবল, আসলে বিপাকে পড়েছে সোমা, কাজেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। যে—ভাবেই হোক ওকে বোঝানো যত সহজ ভাবছে বিনু, ব্যাপারটা, তত সহজ নয়। সে বলল, জানিস একরাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে!
বিনু খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল, কী!
মনে হল, আমার সেই মানুষটি, বড় মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং সোমা সে রসুলকে নিয়ে এক রাতে বের হয়েছিল সে কথাও বলল। তারপর সেই বৃদ্ধ মানুষের খবর, তার আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকা, কেউ তার কাছে আসে, খড়কুটো দিয়ে যায় তাও বলল। সোমা বলল, আমার মনে হয়েছিল, সেই লোকটাই অঞ্জন।
বিনু খুব অনায়াসে বলে ফেলল, তা হতে পারে।
কিন্তু তারপরের ব্যাপারটা কী হবে!
সেটা আবার কী?
এসে দেখলাম গাড়ি বারান্দার ছাদে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
তা থাকতে পারে!
কী করে!
অন্য কেউ কি গাড়ি বারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না?
ভোর রাতে কে আসবে।
তোমার বাড়িতে মানুষের তো অভাব নেই।
কেউ তো স্বীকার করল না।
স্বীকার না করলেই দাঁড়াবে না সে কথা কে বলল!
এমন সহজ কথা স্বীকার করতে ক্ষতি কী!
সোমা ভাবল কত অনায়াসে সমাধান বিনুর। আসলে বিনু মানুষটাই এ—স্বভাবের। সহজে সবকিছু ভেবে নেওয়ার স্বভাব। সে বলল, বাড়িতে এতসব ঘটনা একের পর এক ঘটছে, আর কেউ আর একটা নতুন ঘটনা ঘটিয়ে ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তুলবে আমার বিশ্বাস হয় না।
বিশ্বাস সহজে কিছু হয় না। তোমার বাড়িতে মনোরমা আছে, রসুল আছে, রামঅবতার না কে আছে, মালিরা আছে। মনোরমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক যে তোমাদের অগোচরে কেউ ঘটায়নি সে কে বলবে।