বিনু বলল, কী বলছিস যা তা।
কী আর বলব, আয়।
কী হয়েছে বলবি তো!
না এলে বলতে পারছি না। তুই আয়। আমি মরে যাব বিনু একা থাকলে আমি মরে যাব।
যাচ্ছি। বিনু বাড়ি ফিরে দরজায় দাঁড়িয়েই বলল, মা সোমা আমাকে ডেকেছে। ফোনে আমাকে যেতে বলেছে। সে সোমার সর্বনাশের কথা বলল না। বলল না এইজন্য যে, বললে, আরও দশটা কথা বলতে হবে। ওর তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। তা ছাড়া যে—কোনো ঘটনাতেই মা এমন করতে থাকেন যে, নিজের হোক পরের হোক, একেবারে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যান। মাকে এ—সময়ে আর দুঃখে ভাসিয়ে কাজ নেই।
মা বলল, কিছু খেয়ে যাবি না? এই সাতসকালে বের হচ্ছিস!
ওখানে খাব। তুমি ভেবো না।
সে যখন চলে যাচ্ছিল, রাস্তায় হনহন করে হাঁটছিল, মা তখন জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, কখন ফিরবি!
হয়ে গেলেই ফিরব।
এখন এমন একটা সময় যে, বের হয়ে গেলে কেউ আর ফিরবে কি না ঠিক থাকে না। কেউ ওকে, সোমা ডাকছে বলে, ডেকে নিয়ে গেল না তো! আজকাল তো এ—ভাবেও অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। বিনু চলে গেল। ওকে আর দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে এমন অরাজকতার ভিতর বিনু কেন যে এত সকালে বের হয়ে গেল। জানলায় মার মুখ দেখলে এ—ছাড়া এখন আর কিছু মনে হবে না। সংসারে বিনুই ওদের পারাপারের কড়ি। সে না থাকলে সংসারের কী হতে পারে, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
বিনু সোমাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। সব ঠিকঠাক আছে। রসুল গেটে পাহারা দিচ্ছে। সেই মাধবীলতার গুচ্ছ গুচ্ছ নীলাভ পাতাসকল চারপাশে দেয়ালের, সেই মারবেল বিছানো পথ, সেই ইউক্যালিপটাসের গাছ আর সেই কামিনী ফুলের গাছ, শীতের সময়, এবং শীতকালীন রোদে একটা ভারি মনোরম আমেজ আছে। একটা শীতের কাক পর্যন্ত ডাকছে দেয়ালে। দুটো একটা শালিক পাখিও সে দেখতে পেল। কেবল মনে হচ্ছিল, দু’জনের পক্ষে এটা সত্যি খুব বড় বাড়ি। ও—পাশে গ্যারেজ। সে ভেবেছিল, কোনো একটা খুন—টুনের ব্যাপার হবে। কিন্তু এমন নিরিবিলি এতবড় বাড়িটা দেখে, সে বুঝতে পারছে না, কী হয়েছে! সে ভিতরে ঢুকল, রসুল উঠে সেলাম দিল। বিনু ভাবল একবার রসুলকে জিজ্ঞাসা করবে, কিন্তু এ—বাড়ির আভিজাত্যের খবর সে রাখে। ভিতরে কী হচ্ছে না হচ্ছে, ওরা সহজে জানতে পারে না। জানতে পারলেও না—জানার ভান করে থাকে। খুব নিজের লোক না হলে কিছু প্রকাশ করে না। বিনুকে রসুল দুবার কী তিনবার বেশি হলে দেখেছে। সুতরাং রসুলের কাছেও কোনো খবর সে পেতে পারে না। সে প্রায় ছুটে নুড়ি—বিছানো পথের ওপর দিয়ে বের হয়ে গেল এবং কাঠের সিঁড়ি প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেল। কিন্তু লম্বা করিডোরে কেউ নেই। খাঁ খাঁ করছে যেন। সে দেখেছে এখানে এই করিডোরে এলেই কেউ—না—কেউ দাঁড়িয়ে থাকে ওকে ভিতরে নিয়ে যাবার জন্য। এবং এমন অবস্থায় পড়লে ঘাবড়ে যাবার কথা। সে এখন কী করবে ভেবে পেল না।
আর তখনই দেখল, সোমা শীতের চাদর গায়ে কেমন পীড়িত চোখে মুখে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এতবড় বাড়িতে এভাবে না হাঁটলে বুঝি সৌন্দর্য বাড়ে না। সোমা এই সকালেও সুন্দর করে সেজে বসে আছে, ওর চুলে কোনো অন্যমনস্কতা নেই, পরিপাটি করে চুল বাঁধা। সোমা কী সকালে উঠেই চুল বাঁধতে বসেছিল। সোমা যে গতকাল খুব সুন্দর করে সেজে বসেছিল, মনীষ ফিরলেই অনন্ত জলরাশি আছে পৃথিবীতে, সেই জলরাশিতে অবগাহন কী যে আরামের এবং লম্বা বিছানায়, সাদা চাদরে সোনালি ফুল ফল আঁকা চাদরে কেবল সাঁতার কাটা এবং নরম বিছানার সঙ্গে কেবল মিশে যাওয়ার জন্য এ—মেয়ে যে গতকাল সেজে বসে থেকে সারারাত প্রতীক্ষায় ছিল, মনীষ ঠিক ফিরবে, ফিরছে, অনেক রাতে ওর মনে হল মনীষ ফিরছে না, টেবিলে একটা চিঠি, চিঠিটা আবিষ্কারের পর সে চুপচাপ সারারাত একই জায়গায় বসেছিল। নিথর। টেবিল থেকে এই সকালে মাত্র সে ফোন তুলে এক এক করে সবাইকে ফোন করছে। প্রথমে বিনুর পালা।
বিনুকে দেখে সোমা বলল, আয়।
বিনু পার্লারে ঢুকে গেল সোমার সঙ্গে।
বিনু বলল, কী ব্যাপার বলতো!
বোস।
বিনু বসল। সোমাও ধীরে ধীরে বসল। সোমা বিনুকে অপলক দেখছে। এত বেশি বিনুকে দেখছে, যে বিনুর ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল। যেন এই যে সর্বনাশ ঘটেছে, কী সর্বনাশ সে এখনও জানে না, তবু একটা কিছু যখন ঘটেছে, তার জন্য দায়ী বিনয়, এবং বিনয়ের দিকে এমন একটা চোখেই যেন তাকিয়ে আছে সোমা। কিছু বলছে না।
বিনু বলল, মনীষ কোথায়?
সোমা বলল, বোস বলছি।
সোমা, মনে হয় কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না, অথবা কোথা থেকে আরম্ভ করবে বুঝতে পারছে না। সে বলল, আমি কীভাবে আরম্ভ করব ঠিক বুঝতে পারছি না।
বিনু বলল, কী হয়েছে বলবি তো!
সোমা ধীরে ধীরে বলল, মনীষ চলে গেছে।
কোথায়!
জানি না।
কিছু বলে যায়নি!
না।
কবে গেল?
কাল!
কাল কখন!
রাতে। আর ফিরে আসেনি। টেবিলে চিঠি। আমি চলে যাচ্ছি। বলে চিঠিটা বিনুকে পড়তে দিল।
বিনু চিঠিটা পড়ল। বিনু পাজামা পাঞ্জাবি পরেছিল। সে সেই পরে চলে এসেছে। দুদিন পরেছে বলে খুব চাকচিক্য নেই জামাকাপড়ে। তবু বিনুর চোখেমুখে কী যেন আছে, যা দেখলে খুব নিজের মানুষ মনে হয়। সব সহজেই বলা যায়। বিনু পড়ে বলল, খুব ছেলেমানুষ তো!
তুই বল বিনু, এটা ছেলেমানুষী না!
আপাত তাই মনে হচ্ছে। ওকে কী কেউ ভয়—টয় দেখিয়ে ছিল?