হ্যাঁ।
শুনতে পাচ্ছিস। আমি কী বললাম, শুনতে পাচ্ছিস!
হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি।
কিছু বলছিস না কেন?
কী বলব!
তোর কী মত!
আমার মত, এভাবে কি সমস্যা সমাধান হবে!
সমস্যা সমাধান কথাটা যেন ভীষণ লম্বা কথা। ভাগে ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। অনেক লম্বা অঙ্ক। অনেকবার, বারবার কষে কষে দেখতে হবে ব্যাপারটা কী। এবং এ—জন্য বোধহয় ওরা দুজনই চুপচাপ ফোনের দু প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না।
সোমা আর থাকতে না পেরে বলল, বিনু এত কী বলছে!
মনীষ বলল, একদিন আসিস।
যাব।
ছাড়ছি।
আচ্ছা।
ওরা দুজনেই ফোন ছেড়ে দিল।
কিছু বলছ না যে?
মনীষ সোফাতে গা এলিয়ে দিল। আসলে ও আর দাঁড়াতে পারছিল না। ওর হাত—পা কাঁপছিল। সে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে বোধহয় পড়ে যেত। সে বলল, কিছু না।
কিছু না মানে।
কিছু না মানে কিছু না।
সোমা অধৈর্য গলায় বলল, এতক্ষণ কেউ কিছু না বলে থাকে না।
এখন এ—সব কথা ওর বলতে ভালো লাগছে না। সব ব্যাপারটাই ভীষণ গণ্ডগোলের। সে অবিশ্বাসের চোখে সোমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
এমনভাবে কী দেখছ আমার!
আচ্ছা সোমা, সত্যি কি তুমি সেই চোখ দুটোর খবর পেয়েছ!
সোমা হেসে দিল। বলল, বলতে হয় বলা।
মনীষ তবু বিশ্বাস করতে পারল না সোমাকে। সবাই কী তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই বলল, সোমা, সে ওকে দেখেছে। সে বুঝতে পেরেছে লোকটা কে! অথচ এখন বলছে, বলতে হয় বলা। সেও আর ধৈর্য রক্ষা করতে পারছে না। হুজুরিমল কি সব জেনে ফেলেছিল। ওর সংসারেও কি এমনভাবে একটা লুকোচুরি খেলা, ঠিক ডেথ ডেথ খেলার মতো ব্যাপার ঘটেছে! সে চিৎকার করে বলল, ঠিক তুমি ওকে খুঁজে পেয়েছ। আমার কাছে এখন তুমি মিথ্যা কথা বলছ!
কীসে কী যে হয়ে যায়! সোমা বলল, সত্যি বলছি, আমি জানি না। বিনুর এত ঔৎসুক্য আমার ভালো লাগছিল না। এ—জন্য বলছি সে আছে।
মনীষ আর পারছে না। সে আবার চিৎকার করে বলে উঠল, এখানে আর থাকছি না। আমি ঠিক পালাব।
এবং সে রাতেই মনীষ কলকাতা ছেড়ে একা পালাল। কাউকে কোনো ঠিকানা দিয়ে গেল না। সোমা সকালে সবাইকে ফোনে জানাল, গতকাল থেকে মনীষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এখন কী যে করি!
চৌদ্দ
সুতরাং সকালের দিকে বাড়িতে একটা থমথমে ভাব। সোমা সবাইকে ফোনে খবরটা দিয়েছে। পুলিশে এখনও খবর দেওয়া হয়নি। মনীষ একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে। শুধু লিখেছে, আমি যাচ্ছি। কলকাতায় থাকলে, আমি পাগল হয়ে যাব। কাউকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। সংসারে এ—সব যখন হচ্ছে, তখন তাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। পরিচয়হীনভাবে কিছুদিন থাকছি। এ—সময়ে বোধহয় এর চেয়ে আর বড় উপায় আমার জানা নেই। আমার জন্য চিন্তা করবে না। বড়বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে কারখানা চালাবে। আর মনে রেখো, ইচ্ছা করলেই সব একদিনে পালটানো যায় না। তুমি হলেও পারতে না। আমরা সবাই ভীষণ অসহায়। অসহায় হলে প্রত্যেক মানুষই নিজের নিরাপত্তার জন্য যে—ভাবে হোক টাকা রোজগার করে যাবে। এখন তুমি যা ভালো মনে কর করবে। সোমা চিঠিটা বারবার পড়ে অনেক ভেবেছে। এখন কার কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়, বিনুকে ডাকলে হয়, সুধীর অথবা অশোক এবং অসিতবাবু, এরাই তাকে কী করা দরকার পথ বাতলে দিতে পারে।
প্রথম ওর দরকার বিনুর সঙ্গে। প্রথমে সে বিনুকেই ফোন করছিল।
বিনুর পাশের বাড়িতে ফোন আছে। ওর নেই। দরকার—টরকার পড়লে ডেকে দেয়। এমন সকালে কে ফোন করছে সে বুঝতে পারল না। সে ভাবল, বোধহয় পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে। কারণ হাসপাতালে ওর ভাই। ওর ভাই কি তবে মারা গেছে! ফোন যখন কিছু আরজেন্ট ব্যাপার। না হলে এমন সাতসকালে কেউ ফোন করে না। ওর বুকটা ফোনের খবর পেয়েই ধক করে উঠেছিল। মা ছুটে এসেছিল, ফোন, ফোন কেন রে!
এমন সময়ে বাড়ির সবাই খুব সতর্ক থাকে। যেন যে—কোনো সময়ে ফোনে একটা দুর্ঘটনার খবর আসবে। পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, এবং অসুস্থ সে, হাসপাতালে আধমরা হয়ে পড়ে আছে শুনে মা যেন খুব নিশ্চিন্ত ছিল। যা—হোক এখন আর তত ভয় নেই। বাইরে থাকলেই ভয়। কে কখন কোনদিক থেকে আক্রমণ করবে ঠিক কী। এখন তো শোনা যাচ্ছে, দলের ছেলেরাই দলের ছেলেদের খুন করছে। অবিশ্বাস দানা বাঁধলে যা হয়। আর তখনই কিনা সাতসকালে ফোন। মার উদবিগ্ন মুখ দেখে বিনু বলেছিল, যাচ্ছি। এত উতলা হলে চলবে কেন!
বিনু সাহস পাচ্ছিল না ফোনের কাছে যেতে। এটা আজকাল তার নিজেরও হয়েছে। বাবা মারা যাবার পর সেই ছোটভাইদের মানুষ করার ভার নিয়েছিল। সে নিজে আর বেশি পড়াশোনা না করে, সংসারের রোজগার কী করে বাড়বে এবং ভাইয়েরা কী করে মানুষ হবে এই ছিল তার একান্ত দায়িত্ব। আসলে সে ওদের মানুষ করছিল নিজের ছেলের মতো। এদের নিয়েই তার সব কিছু। এদের ছাড়া সে নিজেকে ভাবতে পারে না। এবং কোনো ফোন এলেই কী যেন ভয়াবহ একটা খবর রয়ে গেছে মনে হয় ফোনে।
সে কোনোরকমে ফোন ধরলেই শুনল, সোমা কথা বলছে। সে আর ভয়ের কিছু ভাবছে না। বোধহয় কোনো পিকনিক টিকনিকের খবর দেবে সোমা। ওদের তো কোনো চিন্তাভাবনা নেই তাকে সেটা জানাতে চায়। সে বলল, কিরে কেমন আছিস!
সোমা কেমন কথা বলতে পারছে না। ওর গলা জড়িয়ে আসছে। সে তবু যেন কোনোরকমে বলল, আমার সর্বনাশ হয়েছে! তুই শিগগির চলে আয়।