মনীষের মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। হাত ঠক ঠক করে কাঁপছে। সে কথা বলতে পারছে না দেখে তাড়াতাড়ি ফোন সোমা কেড়ে নিল। বলল, হ্যালো, কে আপনি।
বিনু বলছি।
বিনু! কেমন কিছুক্ষণ ফোনের ওপর সোমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কিছু বলতে পারল না। বিনুর গলা, যেন অনেক দূর থেকে কেউ অভয় দেবার মতো কথা বলছে। এবং বিনু খুব সহজে বলে গেল, মনীষের শরীর কেমন!
সোমা ভেবে পেল না, এমন সব কথা বিনু বলছে কেন? সে বলল, ভালো। ভালো বলেও নিস্তার নেই, আর ভেবে পেল না বিনু কুশল নিচ্ছে কেন! বিনু তো কতদিন হয়ে গেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর আর মনীষের কুশল নেয়নি। বিনুর ভাই, কী যেন নাম, এখন সুখী রাজপুত্র, স্বপ্ন দেখছে, পৃথিবী পালটে দেবে, সেই কী খবর দিয়েছে, দাদা তোমার বন্ধুর শরীর ভালো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে খবর নেবে। সোমা বলল, হঠাৎ এ—কথা বললি কেন?
হঠাৎ নয়তো! মনে হল তোদের কিছু হয়েছে। আমাদের খুলে বলছিস না। তুই চলে যাবার পর এটা আমার মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, তোর কথাবার্তা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। তারপরই ভাবলাম তোকে একটা ফোন করি, তুই কেমন আছিস, মনীষ কেমন আছে?
সোমা বলল, ও! আমরা ভালোই আছি।
বিনু বলল, আমরা ভালো নেই। ভাইটি আমার ধরা পড়েছে। তবে ভাগ্য আমাদের, গুলি করেনি পুলিশ। তবে যা মেরেছে, ওর আর জীবনে কিছু করে খেতে হবে না।
কবে হল এটা।
তুই যাবার পরই খবর এল। আমরা গেলাম। আসলে সে বেশ ক’দিন আগেই ধরা পড়েছে। আমরা জানতাম না। দেখামাত্রই গুলি—এই নির্দেশ ছিল পুলিশের। যখন জানতে পারলাম, না তা হয়নি, প্রাণে বেঁচে গেছে, তখন সোমা, তোকে কী বলব, কী যে আনন্দ আমাদের। মা এখন আর দুঃখী না। জেলে আছে, আর কিছু হবে না এমন ভেবেছে। জেলেও অবশ্য ঠিক নেই। ওদের মেডিকেল ওয়ার্ডে আছে। দেখে এলাম। পাশ ফিরতে পারছে না। তবে বাঁচবে, মরবে না। ওরা তো এত সহজে মরে না!
কেন মরে না!
মরবে কী, ওরা তো বারবার এ—ভাবে মার খায়।
মার খেয়েও বাঁচে।
তা বাঁচে বোধহয়। না হলে এ—সব হচ্ছে কী করে!
সোমার ভালো লাগছিল না! মনীষ বুঝতে পারছে না এমন অন্তরঙ্গভাবে সোমা কার সঙ্গে কথা বলছে! একবার বলছিল সোমা, বিনু! বিনুর সঙ্গে তবে কথা বলছে! কিন্তু বিনুর সঙ্গে কথা বললে, সোমার তো এ—ভাবে কথা বলার স্বভাব না। কেমন অপরিচিতের মতো কথা বলছে, আসলে কী সেই লোকটা কখনও সোমার কাছে বিনু হয়ে যায় অথবা অশোক, অথবা অঞ্জন। সেই লোকটা কী পৃথিবীর সব ভালো কথা বলে বেড়ায়। সব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র এবং আবাসের ব্যবস্থা থাকবে। সেটা তো ভালো কথা। সেটা তো সেও চায়। সব মানুষ সুখে থাকুক। কিন্তু সব মানুষ যখন সুখে থাকতে পারে না, তখন সে একা কী করতে পারে। সব মানুষের জন্য যখন সব থাকে না, কিছু কিছু মানুষের জন্য যখন সব থাকে, তখন তাকে বাধ্য হয়ে কিছু মানুষের দলে ভিড়ে যেতে হয়। সে বলল, কার সঙ্গে কথা বলছ?
বিনুর সঙ্গে।
বিনু কথা বলছে!
হ্যাঁ।
কী বলছে?
বলছে, তুমি কেমন আছো?
তবে আমাকে দাও, আমি কথা বলছি।
সোমার হাত থেকে মনীষ ফোন তুলে নিল। বলল, কীরে ব্যাটা বিনু! খুব উৎফুল্ল দেখাতে চাইল। সেদিন দেখা হবার পর যে ওদের বাড়িতে একটা ভয়ংকর কাণ্ড রাতদিন জেঁকে বসেছে, সেটা সে কথাবার্তায় একেবারে বুঝতে দিল না।
বিনু বলল, সোমা সেই লোকটাকে খুঁজে পেয়েছে!
মনীষ কী বলবে বুঝতে পারল না। সে সোমার দিকে তাকাল। সোমা চোখ টিপে বলল, বলে দাও, পাওয়া গেছে।
মনীষ বলল, পাওয়া গেছে!
যাক তবে নিশ্চিন্ত সোমা।
মনীষ তাকাল সোমার দিকে। সোমা বুঝতে পারছে না কী বলবে। ফোনের মুখে হাত রেখে বলল, বলছে, যাক তবে নিশ্চিন্ত!
বলে দাও, নিশ্চিন্ত।
মনীষ বলল, নিশ্চিন্ত।
বিনু এবার বলল, কে লোকটারে?
মনীষ কী বলবে! সে বলল, দাঁড়া জিজ্ঞেস করি! সে সোমার দিকে তাকিয়ে বলল, কে লোকটা জিজ্ঞেস করছে!
সোমা বলল, সে আছে।
মনীষ বলল ফোনে, সে আছে।
বিনু বলল, জিজ্ঞেস কর তো আমরা তাকে চিনি কি না?
মনীষ বলল, বিনু জিজ্ঞেস করছে, আমরা তাকে চিনি কি না!
সোমা বলল, না।
মনীষ বলল, না। আমরা কেউ তাকে চিনি না।
বিনু বলল, ভালো কথা না।
নিশ্চয়ই না।
বিনু বলল, সেই লোকটাই যত নষ্টের গোড়া।
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
সোমা কেন যে এ—ভাবে ঘুরে বেড়ায় বুঝি না!
আমিও না।
তারপর দুজনই চুপচাপ।
বিনু বলল, শুনেছিস!
কী!
বড়বাজারে হুজুরিমল আগরওয়ালের গলা কেটে দিয়েছে। একেবারে দিনের বেলা হাজার লোকের সামনে। তিন চারটি ছেলে এল। বলল, আপনারা যে যার কাজ করে যান। এদিকে তাকাবেন না। লোকটিকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করেছি। বলে গোটা চারেক বোমা। ব্যাস ট্রাম বাস বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা। দেখা গেল হুজুরিমল রাস্তায় চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। অত বড় ভুঁড়ি নিয়ে পড়ে আছে যে দেখলে পর্যন্ত কুৎসিত লাগে। পৃথিবীর সবকিছু বেনামিতে লোকটা গিলতে চেয়েছিল। ওরা ঠিক টের পায়। ভালোই হচ্ছে। একদিকে এটা তার কাম্য ছিল। না হলে শালা এই ভারতবর্ষের লোক মানুষ হবে না। এমন অসাম্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে জানি না। কিছু লোক কেবল ক্রমাগত বড় লোক হচ্ছে,…হচ্ছে…হচ্ছে। সেই ভাঙা রেকর্ডের মতো গলা। কিন্তু আশ্চর্য বিনু ফোনে হাঁ হুঁ শুনতে না পেয়ে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। বলল, এই শুনছিস!