মনীষ বলল, তুমি এখানে বসো।
মনোরমা ভেবে পেল না, দাদাবাবু এমন বলছেন কেন! ঠাট্টা করছেন না তো! তিনি তো কখনও ওর সঙ্গে ঠাট্টা করেন না, সে কেমন হতভম্ব। সে তেমনি দাঁড়িয়ে থাকল।
কী বললাম!
দাদাবাবু আপনি এ—সব কী বলছেন!
ঠিক বলছি। তুমি বসো!
আমি কবে ওখানে বসেছি।
এখন থেকে তোমরাই ওখানে বসবে।
মনোরমা এখন কী যে করে! সে খুব সংকোচের সঙ্গে এগিয়ে গেল। দাদাবাবু পাগল হয়ে যাচ্ছে, সে ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে বসল।
মনীষ বলল, লোকটা আগে বের হয়েছিল পার্লার থেকে, না তুমি।
তিনি ভিতরে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে। আমাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল, আমি গেলাম।
ঠিক আছে। এবারে তুমি আমায় পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটো।
মনোরমা পাগলের পাল্লায় পড়ে গেছে! নতুবা বাড়িটাতে এমনভাবে একটা উপদ্রব দেখা দেবে কেন। এঁরা কী যে হাসিখুশি ছিল, ক’দিনে বাড়ির চেহারা কী হয়ে গেল! যেন চেনা যায় না, কেউ কাউকে চেনে না। সবসময় কী এক ভয়াবহ দৃশ্য ঝুলে থাকে। সবসময় মনে হয় কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। কেবল সময় গুণে যাচ্ছে। যে—কোনো সময় দেখা যাবে, পার্লারে অথবা করিডোর অথবা বাগানে কেউ মরে পড়ে আছে। মনোরমা কথামতো পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল। সে সিঁড়ির দিকে গেলে সে দেখতে পেল, দাদাবাবু রান্নাঘরের দিকে ঠিক একজন মেয়ের যেভাবে হেঁটে যাবার কথা তেমনি হেঁটে যাচ্ছেন। সে এমন দেখে হাসবে কী কাঁদবে ভেবে পেল না। সে শুধু যেমন একজন লোক এসে নেমে যায় সিঁড়ি ধরে তেমনি নেমে গেল।
এটা রান্নাঘর না বলে প্যান্ট্রি বলাই ভালো। প্যান্ট্রিতে ঢুকে মনীষ খুব সন্তর্পণে সেই পায়ের শব্দ শুনতে থাকল। নেমে যাচ্ছে। প্যান্ট্রিতে দাঁড়িয়ে সত্যি তবে শোনা যায়। মনোরমা কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। মনোরমা হুবহু ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, ভাঙা রেকর্ডের মতো ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে, সে দু—কানে হাত রেখে একেবারে সোজা ঘরে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, মনোরমা নিচের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দাও। বাগানের দিকে রসুলকে পাহারা দিতে বল। রাম অবতার গেটে থাকুক। কেউ যেন ভিতরে ঢুকতে না পারে!
এবং এমন চেঁচামেচিতে মনে হয় সোমা জেগে গেছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, মনীষ এমন করে চিৎকার করছে কেন। সহসা ঝড় উঠলে, যেমন ঘরের দরজা জানালা ছুটে ছুটে বন্ধ করে দিতে হয়, তেমনি মনীষ দরজা জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। সে ভেবে পাচ্ছে না, এটা করছে কেন মনীষ। এখন তো বেশ পরিষ্কার শীতের আকাশ। মনীষ এতক্ষণ কোথায় ছিল, সে কোথায় ছিল! সে তো বাথরুমে ছিল, তারপর, তারপর, হ্যাঁ মনে পড়ছে দুটো চোখ, তারপর তারপর, সে কী ভেবে বলল, তারপর কী মনীষ?
মনীষ দেখল সোমা একেবারে তাজা মেয়ের মতো বিছানায় হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে। কে বলবে সে জ্ঞান হারিয়েছিল। কে বলবে, বাড়িতে এমন তুমুল কাণ্ড ঘটে গেছে। কেউ এসেছিল, সোমার জন্য। সে কে! সোমা কি কাউকে আসতে বলেছিল!
মনীষ বলল, তুমি খাওনি সোমা!
তুমি খেয়েছ?
না।
দরজা জানালা বন্ধ করে রাখছ কেন!
একটা লোক এসেছিল। তুমি তখন বাথরুমে ছিলে।
সে কোথায়!
চলে গেছে।
তাকে চলে যেতে দিলে কেন!
আমি কি বাড়ি ছিলাম! এসে শুনলাম।
দরজা জানালা খুলে দাও। লক্ষ্মী আমার। দরজা জানালা বন্ধ করে রাখলে শ্বাস ফেলতে পারি না, কেমন কষ্ট হয়।
কিন্তু সে যদি আসে!
এলে তাকে বসতে বলবে।
মাই গড। পুলিশে খবর দেব না?
পুলিশে খবর দিতে নেই। শোনো।
মনীষ কাছে এগিয়ে গেলে সোমা বলল, তুমি ভালো হয়ে যাও। ভালো হলে আমাদের কোনো আর ভয় থাকবে না। না হলে তুমি পাগল হয়ে যাবে মনীষ। আমিও।
মনীষ বলল, আমি কি ভালো হব?
মানুষের অনিষ্ট করে টাকা কামিয়ো না।
মনীষ হাসল। মেয়েমানুষের মতো কথা। সে অবশ্য খুলে কিছু বলল না। কেবল বলল, ভাবা যাবে। এখন তো আমরা দরজা জানলা বন্ধ করে থাকি।
সোমা কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। মনীষের ভিতর এক পাপ, টাকার পাপ, অথবা লোভ, চারপাশ থেকে এই বাড়ি, ফুল ফল বাগান ঘিরে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, মনীষ আর ইচ্ছে করলেও বোধহয় সরে আসতে পারে না। কিন্তু সোমা বুঝতে পারে এ—ভাবে বাঁচা যায় না। সে উঠে দরজা জানালা খুলে দিতে থাকল। বলল, হাওয়া আসতে দাও।
মনীষ বুঝতে পারল না কী করবে। সে খুব একটা জোরজারও করতে পারে না। সেদিন কেন যে মরতে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, আর সেই থেকে এক এক করে উপদ্রব। এবং মনে হয় এ—ভাবে চললে, ভয়ে সে নিজেই আত্মহত্যা করে বসবে। সে বলল, সোমা, আমরা কিন্তু কেউ খাইনি।
এই খাবার নাম শুনলে, অথবা মনীষ খায়নি শুনলে একটু স্বাভাবিক মুখ হয়ে যায় সোমার। সে টেবিলে বসে বলল, এসো।
ওরা দুজনে মুখোমুখি চুপচাপ খেতে থাকল। আজ যত টেলিফোন এসেছে সবার কাছে এক জবাব, মিস্টার দত্ত বাড়ি নেই। মিসেস দত্ত বাড়ি নেই। ওরা বাড়ির ভিতরই ক্যামোফ্লাইজ করে থাকবে ভাবল। কিন্তু বিকেলের দিকে একটা ফোন এল, ফোনে কে একজন কথা বলবেই। যত রসুল বলল, সাহেব বাড়িতে নেই, তত জেদ। বলছে, আমি জানি আছে, তুমি দাও। লাইনটা ওপরে দেবে কী না ভাবছে রসুল। সে যত বলছে, সাহাব নেই, তত সে বলছে, আছে, আমি জানি আছে। আমার সঙ্গে নেই বলে কী হবে!
আর লাইনটা দিয়েই রসুল, সাহাব, বাবুজী বলছে, আপনি আছেন ওকে নেই বলে কিছু হবে না!