শান্তিবাবু বলল, আমি আর নামছি না। শরীরটা ভালো নেই।
মনীষ জবাব দিল না। শান্তি এক নম্বর গেছে শুনে নিচে নেমে যেতে পর্যন্ত সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু দরজার কাছে গেলে ফের শান্তিবাবু ডাকল, মনীষ শুনতে পাচ্ছ?
কী?
কেমন জোরে জোরে খুন্তি নাড়ছে?
তা শুনতে পাচ্ছি।
স্পাই নাতো!
কী করে বলব!
কিছু বলতেও পারি না! যা খুশি করছে!
রাখছ কেন? লাথি মারতে পারছ না?
মারব। সময় আসুক। এমন লাথি মারব না, একেবারে উলটে পড়বে। নাক থেঁতলে যাবে। গল গল করে মুখ দিয়ে রক্ত বের হবে।
আর তখনই চাকরটা এদিকে আসছে দেখে মনীষ চোখে আঙুল রেখে ইশারা করল। তারপর বলল, যাচ্ছি।
যাও।
ছোকরা চাকরটা এদিকে এসেই আবার বাঁই করে ঘুরে গেল। যেন কী আনতে ভুলে গেছে। সেটা নিয়ে সে নিচে নেমে যাবে। এখন মনীষ ভাবতে পারছে না, আসলে ওর মতলব কী! সে দ্রুত দু লাফে সিঁড়ি ধরে নেমে গেল। এবং সেও বাঁই করে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। এলোমেলো চালিয়ে যখন গাড়ি নিয়ে বাড়ি ঢুকল তখন এক কঠিন কাণ্ড। মনোরমা হাই হাই করছে। অসিত নেমে যাচ্ছে। ওর ভিতরটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। সে বোকার মতো অসিতকে দেখল, কিছু বলতে পারল না। অসিত বলল, ভিতরে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
তেরো
সোমার মনে হল কেউ ডাকছে। অনেক দূর থেকে ডাকছে। সে চোখ খুলে তাকালে দেখল, পাশে মনীষ দাঁড়িয়ে। সে মনীষকে ঠিক চিনতে পারছে না বোধহয়। একটা অসীম শূন্যতার ভিতর সোমা ডুবে যাচ্ছে। ঠিক ডুবে যাচ্ছে কিনা বলা যায় না, কেমন ডুবে যেতে তার ভালো লাগছে। এবং চোখ বুজলেই কেমন সে হালকা, বাতাসে ভর দিয়ে সে যেন অনেকদূর চলে যেতে পারে। তার দুটো হাত এখন পাখির ডানার মতো। অথবা বাতাসে সাঁতার কাটার মতো সে এগিয়ে যায়, আর এখন কেউ ডাকলে মনে হয়, অনেক দূর থেকে, যেন কেমন অনন্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ছোট একটা নক্ষত্রের মতো তাকে বলছে, সোমা, তোমার তো কাজল পরার কথা ছিল না। চোখে কেন যে কাজল পরতে গেলে।
সোমা বলল, আমি কাজল পরি না। কখনও পরি না। সেই যে তুমি বললে, তারপর থেকে পরি না।
মনীষ দেখল সোমা চোখ বুজেই বিড়বিড় করছে। এমন দেখলে কে আর স্থির থাকতে পারে। অসিতের সঙ্গে পরামর্শ দরকার। সে এখন কী করতে পারে। আসলে ভয়ে এমন হয়েছে। ওর চেয়ে সোমা বেশি ভয় পেয়ে গেছে। সে এ—ভাবে এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবে। সে এবার চিৎকার করে ডাকল, মনোরমা মনোরমা!
মনোরমা ছুটে এল। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
মনীষ বলল, কী হয়েছিল!
কে একজন এসেছিল! বলল সোমা আছে?
সোমা! সোমার কথা বলল!
হ্যাঁ। বলল, ওকে ডেকে দেবে তো।
নাম কী বলল?
নাম বলল না। বলল, এলেই আমাকে চিনতে পারবে।
মনীষ নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে পারলে যেন বেঁচে যেত। সে ব্যালকনিতে ছুটে এসে ডাকল, রসুল! রসুল!
রসুল ছুটে এলে বলল, কে এসেছিল।
কেউ নাতো সাব।
কেউ না!
না।
মনোরমা। সে আকাশ ফাটিয়ে বলল, এসব বাড়িতে কী হচ্ছে! আমি সবাইকে তাড়িয়ে দেব। তোমরা সবাই নেশা করছ।
না দাদাবাবু নেশা করছি না। আমি বললুম, বসুন। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দিদিমণিকে দেখতে পেলাম না। বাথরুম বন্ধ। ডাকলাম। কোনো সাড়া পেলাম না। এসে বললাম, বসুন। দেরি হবে।
মনীষ বলল, তুমি বসতে বললে!
মনোরমা দরজার পাশ থেকেই বলল, কিন্তু তিনি বসলেন না। বললেন, ঠিক আছে আমি আবার আসব। হাতে আমার অনেক কাজ। দেরি করলে ক্ষতি হবে।
ইস! কী যে সুযোগ গেল! তারপরই মনে হল সে ছেলেমানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে। রসুল, রাম অবতার এরা কী যে করল, ওরা দেখতে পেল না কেন! না কী রসুল, রাম অবতার সবাই একসঙ্গে ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যেমন, শান্তির চাকরটা খেতে পেত না, ফুটপাথ থেকে তুলে এনে খেতে দিয়েছিল শান্তি, এখন সেই বেশ বড় বড় পা ফেলে হাঁটে। বাবুরা ভয় পেলে সে মজা পায়। এরা কী শান্তির চাকরের মতো এখন ওর বিপদে তামাশা দেখাচ্ছে। এখন কিছু করা যাবে না। সেই যে সময় এলে এক লাথি, শালা সব তখন উলটে পড়বে। মনীষ খুব নরম গলায় মনোরমাকে বলল, দেখতে কেমন!
রাজপুরুষের মতো দাদাবাবু। খুব লম্বা। চোখ বড়। চুল ঘন। রং একেবারে দুধে আলতায়। চোখে না দেখলে মানুষ এমন সুন্দর হয় কেউ বিশ্বাস করবে না।
মনীষ বলল, ও তারপর চলে গেল!
চলে গেল।
কীভাবে গেল।
কাঠের সিঁড়ি ধরে!
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেছিলে!
হ্যাঁ।
মানুষের পায়ের শব্দ!
একেবারে মানুষের মতো। মনোরমা দেখল, কেমন বলতে বলতে দাদাবাবু ভেঙে পড়ছে। অথবা অন্ধকার রাতে কোনো নিরিবিলি জায়গায় ভূত দেখলে যেমন মানুষ ভয় পায়, তেমনি ভয় পেয়ে যাচ্ছে। চোখমুখের অবস্থা দেখে মনোরমার ভীষণ কষ্ট হতে থাকল। এত যার দাপট, নিমেষে, কী করুণ চোখ মুখ হয়ে যাচ্ছে। একেবারে গলা নামিয়ে কথা বলছে, যেন কেউ শুনতে না পায়।
মনীষ বলল, তুমি মানুষের পায়ের শব্দ চেনো!
চিনি বাবু।
শব্দটা হালকা ছিল, না দুপদাপ।
হালকা ছিল। খুব চিন্তিত মনে মানুষ সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমনি।
মনীষ বলল, তখনও বাথরুম থেকে সোমা বের হয়নি!
না।
তুমি তখন কোথায় ছিলে!
রান্নাঘরে।
রান্নাঘর থেকে শোনা যায়!
যায় বাবু।
লোকটা সিঁড়িতে নামতে নামতে তুমি রান্নাঘরে যেতে পার!
পারি দাদাবাবু।
কোথায় বসেছিল!
মনোরমা পার্লারে ঢুকে নীল রঙের একটা সোফা দেখাল।