মনীষ বলল, কাগজে কী দেখছিস?
কিছু দেখছি না!
তবে এ—ভাবে ঝুঁকে আছিস কেন?
খুঁজছি।
কী খুঁজছিস?
বিজ্ঞাপন।
ধুস! বলে মনীষ কাগজটা জোর করে কেড়ে নিল।
মনীষ প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে দেখল সব হত্যাকাণ্ডের কথা লেখা আছে। বেশ জ্বল—জ্বল করছে লেখাগুলো। ছেলেছোকরা বয়সের হত্যাকাণ্ডে সে বেশ মজা পায়, কোনো মজুতদার অথবা পুলিশের হত্যাকাণ্ডে সে কেমন বিবর্ণ হয়ে যায়। পাঁচ—মেশালি হত্যাকাণ্ড কাগজটা জুড়ে, ছোট বড় সব রকমের। আর তাছাড়া সব হত্যাকাণ্ডের কথা লেখা হয় না, যেমন ওদের বাড়ির সামনে, ঠিক সামনে বলা যায় না, একটু পেছনে, রাস্তার ওপর একজন মানুষের গলাকাটা। কে খুন করল, কখন, কারা, কোনো হদিসই পাওয়া গেল না। খবরটা পর্যন্ত কাগজে বের হয়নি। আর এ—ভাবে, চারপাশে যে হত্যাকাণ্ড চলছে, তার ঠিক হুবহু ছবি কেউ দিতে পারে না। বারাসতে আটটা না আটশো কে বলতে পারবে। কীভাবে যে মাটির নিচে সব চাপা দিয়ে কেমন হাত সাফসোফ করে ভালো মানুষ সেজে যাচ্ছে সবাই।
শান্তি বলল, কী দেখলে?
মনীষ কোনো জবাব দিচ্ছে না।
কী দেখবে! আমার কাছে শোনো। আমি না দেখেও সব তোমাকে হুবহু বলে দিতে পারি।
মনীষ বলল, তোমাদের এক নম্বর যিনি তার খবরাখবর তুমি রাখো?
হ্যাঁ।
তিনি কোথায় আছেন?
তিনি এখন এখানে নেই। ওর শ্যালক থাকে গোণ্ডাতে। সেখানে চলে গেছে।
গোণ্ডা! সে আবার কোথায়?
উত্তরপ্রদেশে বোধহয়।
বেনারসের কাছে একটা খুন হয়েছে।
তাতে তোমার কী মনে হয়?
দ্যাখো এক নম্বর কিনা তোমাদের!
এক নম্বর হতে যাবে কেন?
হতেও তো পারে।
শান্তিবাবুর মনে হচ্ছে, না হওয়াটাই শ্রেয়। হলেই, ওর নম্বর কমে আসবে। বুকটা কেমন করতে থাকল। মুখে ভয় ধরা পড়ুক, সে চাইল না। সে বেশ সোজাসুজি তাকিয়ে থাকল। কিছু বলতে পারল না।
মনীষ বলল, তোমাদের এক নম্বরের ঠিকানা জান না?
তা জানি।
ফোন টোন আছে?
তা আছে।
তোমার কলিগ! ফোন করে খবর নেওয়া উচিত।
শান্তি উঠে দাঁড়াল। ফোন করা ঠিক হবে কিনা, কীভাবে ফোন করবে, কী বলবে এ—সব ভাবল। অধীরবাবুর মা আর বোন আছে। এক ভাই আছে। সে বাড়ি থাকে না। বাড়িতে সে ঢুকতে পারে না। সে ভাবল, ফোন করে বলবে, অধীরবাবুর কোনো চিঠি এসেছে কিনা! অধীরবাবুর স্ত্রী এখন কোথায়! যেন পারিবারিক কুশল নেওয়া। ফোনে যে স্বর ভেসে এল, অচেনা। কোনোদিন এমন স্বরে কেউ কথা বলতে পারে সে ভাবতে পারে না। সে বলল, তাহলে…।
হ্যাঁ।
ওটা ঠিক খবর।
বউদির ভাই টেলিগ্রাম করেছেন।
সত্যি খবর।
ও—পাশের কণ্ঠস্বর ভাঙা কিছু আর বলতে পারছে না, কান্নায় ভেঙে পড়ছে। এবং শান্তি একেবারে কেমন সাদা ফ্যাকাশে, দাঁড়াতে পারছে না, কোনোরকমে এসে সোফাতে হেলান দিয়ে বসে বলল, মনীষ, তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের এক নম্বর গেছে।
তারপর ওরা দুজনই চুপচাপ। চা রেখে গেছে। শান্তিবাবুর মা এ—বাড়িতে আছে টের পাওয়া যাচ্ছে না। নিঝুম, নিরিবিলি, কেবল চাকরটা ভীষণ দর্পের সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করছে। কড়াইয়ে সে কিছু ভাজছে, সে এত জোরে জোরে খুন্তি চালাচ্ছিল যে মনে হয়, বাবুদের মজা দেখে সে খুন্তি নেড়ে তামাশা দেখাচ্ছে। আর ওরা দুজন মুখোমুখি। কীভাবে যে সব হয়ে যাচ্ছে! মনীষ বলল, উঠি।
বোসো।
মনীষ এখন উঠি বললেই উঠতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে যখন নেমে যাবে সিঁড়ি ধরে, তখন দু—পাশ থেকে ওরা জড়িয়ে ধরবে। গলার শ্বাসনালিটা টুক করে কেটে দেবে। সে টেরও পাবে না। সে, নিজের গলাকাটা, অর্থাৎ শ্বাসনালি কাটা, রক্ত ওগলাচ্ছে, শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে এমন একটা দৃশ্যের কথা ভাবলেই কেমন চোখে ঘোলা ঘোলা দেখতে থাকে। কেমন তখন নিজেকে কবন্ধের মতো মনে হয়। সে একটা হত্যাকাণ্ডের হুবহু বর্ণনা দিয়েছিল। ভোজালি দিয়ে সাঁই করে মাথাটা কেটে দিলেও মানুষটা মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে। হাওয়ায় হাত দুটো যেন খুঁজে বেড়ায় শ্বাস—প্রশ্বাসের কারুকার্য। তারপর ধপাস করে পড়ে যায়। পৃথিবীতে এমন একটা দৃশ্য মনীষ যে—কোনো সময় তৈরি করে ফেলতে পারে। আর তৈরি করতে পারে ভেবে ফেললেই, সে পায়ে আর শক্তি পায় না। সিঁড়ি ধরে কীভাবে নেমে যেতে হবে সে যেন বুঝতে পারে না।
তবু সে উঠে পড়ল। এখানে আর তাকে কে চেনে। কিন্তু সেই সুদূর গোণ্ডাতে শান্তিদের এক নম্বরকে কে চিনত। এক নম্বর গেছে, এখন দুনম্বর যেখানেই পালাক না রক্ষা নেই। শান্তির সতেরো নম্বর। সতেরো না সাতাশ, না সাত। এত কম সময়ে সে সব গুলিয়ে ফেলছে। সে সতেরো হোক, সাতাশ হোক, আসে যায় না, শান্তি তুমি যাবে। আমিও যাব। তবে শালা আমি আর এখানে থাকছি না। ভেবেই সে সটান উঠে দাঁড়াল। শান্তিকে কিছু বলল না। যারা চিঠি পায় তারা বাঁচে না। লিস্টে নাম উঠে গেলে রক্ষা থাকে না। এখন একমাত্র বিদেশে পাড়ি দেওয়া, আর না হলে অগত্যা একটা শান্তির মতো বর্ম তৈরি করে নেওয়া। শান্তি ওকে চুপি চুপি ভিতরে একটা বর্ম পরতে বলেছিল। লোহার অথবা ভালো বিদেশি ইলেকট্রনিক টিনের প্লেট দিয়ে বর্ম। ফুল হাতা গেঞ্জির মতো ভিতরে পরে থাকবে। গলায় চোপ বসাতে পারে, তা গলাটা ঢাকা থাকবে। চারপাশ থেকে ঢাকা গলার নতুন পোশাক, অথবা সে বলবে এটা প্যাটার্ন এখন পোশাকের, পরে থাকলে, তা গুলি বারুদ এবং হাত চালাচালি সব নিরর্থক হয়ে যাবে।