কড়া তখনও নড়ছে। এই এগারোটায় কে আসবে? হুট করে দরজা খোলার নিয়ম নেই। চাকরটাও সেয়ানা হয়ে গেছে। সে যে ভয়ে ভয়ে আছে, চাকরটা বুঝে ফেলেছে। সে দরজায় খট করে কড়া নাড়ার শব্দ পেলেই দৌড়ে আসে। দরজা খোলার আকুলতা। আগে দরজা ভেঙে ফেললেও ওর সাড়া পাওয়া যেত না। যেন জোর করে পাঠাতে হত। এখন আর সে—সব নেই, একেবারে কান খাড়া। এবং দরজা খোলার কথা বলেই বোধহয় বাবুর মুখ শুকিয়ে যায়, আর চাকরটি তাতে বেশ মজা পেয়ে যায়। শান্তিবাবু এখন নানাভাবে চেষ্টা করছে, মুখ স্বাভাবিক রাখার। যেন ওটা কিছু নয়, যেমন আগে কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সে অনায়াসে চুরুট টানতে পারত, কপাল ঘামত না, এখনও তেমনি চোখ মুখ করতে গিয়ে বুঝতে পারে সে, বোকা বোকা মুখ। এ—মুখের মানে হয় না।
চাকরটা বলল, খুলব বাবু?
খুলবি!
অনেকক্ষণ থেকে কড়া নাড়ছে।
তা নাড়ুক। দ্যাখ না কে?
একজন বাবু মতো মানুষ।
সঙ্গে আর কেউ নেই তো?
না।
সঙ্গে কিছু নেই তো?
না।
বয়স কেমন?
আপনাদের বয়সি।
তা বল। বলেই শান্তিবাবু দরজায় এসে হোল দিয়ে মানুষটাকে দেখল। মানুষটাকে সে চিনতে পারল আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বলল। হ্যাল্লো। তুমি! কী খবর! হঠাৎ আমার এমন সৌভাগ্য!
মনীষ ঢুকেই বলল, দরজা বন্ধ করে দাও।
মানে!
মানে, তুমি কিছু জানো না!
সে যেন কিছু জানে না, এমন মুখে তাকাল।
মনীষ বলল, শুনলাম তোমার লিস্ট তৈরি!
ও একটা ঝুলিয়েছে। ওটা কিছু না।
তুমি কলেজে বের হচ্ছ?
তা হব না কেন। মা, দ্যাখো কে এসেছে!
মনীষ বুঝতে পারল না, লিস্ট টানিয়ে দিলে মুখ কেউ এমন করে রাখতে পারে।—সে ওর পেছনে পেছনে ভিতরে ঢুকে গেল। শান্তিবাবু দরজা বন্ধ করে দেবে ভাবল, কিন্তু ফিরে দেখল, বাড়ির ছোকরা চাকরটা আগেই দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। সে আর দাঁড়াল না। ভিতরে ঢুকে বসার ঘরটার চারপাশটা দেখল। ভালো করে দেখল সে। এখানে যদি ওরা এসে আগেই লুকিয়ে থাকে। মনীষ ফিসফিস করে বলল, ক’দিন আগে!
তা আজ ন দিন হবে।
ন দিনের ভিতর কোনো এটেমপট হয়নি!
না। সময় লাগবে। সতেরো জনের লিস্ট। যার নাম প্রথমে আছে তার আগে যাবার কথা।
তার কোনো ঠিক নেই। সে তারপর কী ভাবল। শরীরে একটা কী রকমের কষ্ট। এমন কষ্ট, অথচ সে বুঝতে পারছে না, কষ্ট কেন। সে বুঝল, ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। বোধহয় গলা শুকিয়ে গেছে। সে শান্তিকে দেখে কেমন একটু সাহস পাচ্ছে। নিজের কষ্টের কথা বলতে পারছে না। এটা আর কিছু নয়, জলের জন্য কষ্ট। সে এতক্ষণে বুঝতে পারল, ওর ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। সে বলল, আমি জল খাব।
শান্তি জলের জন্য ছোকরা চাকরটাকে ডাকল। বলল, ক্ষেত্র, বাবুকে শরবত করে দাও।
শরবত খেলে জল তেষ্টা যায় না। আমি জল খাব শান্তি।
এখন জল খাবে কী শরবত, এ—নিয়ে শান্তির মাথা ঘামাবার কথা না। সে বুঝতে পারছে না, মনীষ হঠাৎ এখানে কেন। ওর কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হবার কথা না মনীষের। মনীষ এ—জন্য ছুটে আসেনি। সে বলল, তোমার দিকে কোনো গণ্ডগোল নেই। পাড়াটা ভালো।
মনীষ জল খেল। জল না খেলে বোধহয় সে ভালো করে কথাই বলতে পারত না। চোখে মুখে ভীষণ আতঙ্ক। শান্তিবাবু মনীষের জল খাওয়া দেখে এটা বুঝতে পারছে। সে ফের বলল, সোমা কেমন আছে? ওর কিছু হয়নি তো?
ওর কিছু হতে যাবে কেন! মনীষ বুঝতে পারল না সোমার কথা এ—সময় আসে কী করে! পৃথিবীর সবাই যদি সোমার জন্য ভাবে তবে সে ভাববে কখন। সে জল খেয়ে যেন কিছুটা সাহস পেয়েছে। এখন সে সহজভাবে কথা বলতে পারছে। সে বলল, তোমার খবরটা পেয়ে কেমন মন খারাপ লাগছিল। ছুটে এলাম।
তা যদি হয়েই যায়, কী করা!
কিন্তু তোমার অপরাধ কী?
ওরা তো অপরাধের কথা জানায় না।
কেউ কেউ শুনেছি অপরাধের কথা জানিয়ে চিঠি দেয়। সে যে এমন একটা চিঠি পেয়েছে তা বলল না। কেউ পেয়েছে, এমন ভাবে কথা বলল। আসলে ওরা এখন দুজন, দেশের কে কোথায় কখন কীভাবে চিঠি পেয়েছে এবং তার ফলাফল সম্পর্কে কথা বলতে উৎসাহী। যদিও শান্তি খুব একটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখাচ্ছে। এটা একটা রোমান্টিক ব্যাপার। কিছু তো করতে হবে। দেশ উদ্ধারের কাজটা যদি গান্ধী না করে যেতেন, তবে বোধহয় এমনটা হত না। ওদের হাতে আর কোনো কাজ নেই। কিছু লোক খুন করে ওরা শোষণ বন্ধ করবে ভাবছে।
তুমি শোষণের কে? মনীষ পায়ের ওপর পা রেখে কথা বলছে। সে একটা চুরুট ধরাল, চুরুট ধরালে মুখে যে আতঙ্কের ছাপ আছে সেটা মুছে যায়। মনীষের চুরুট মুখে চেহারা অন্য রকমের। বরং ওকে তখন খুব চিন্তাশীল মানুষ দেখায়। সে বলল, কী যে এ—সব হচ্ছে!
এটা চলবে। আজ তো আঠারো উনিশটা গেছে।
পত্রিকা তুমি পড়!
না পড়লে শান্তি পাই না।
সোমা আমাকে পড়তে দেয় না। পত্রিকা এলে লুকিয়ে রাখে।
তুমি না পড়ে থাকতে পারো!
পারি না। লুকিয়ে যে আনাব তার উপায় নেই।
কেন আজকাল অফিসে যাচ্ছ না?
শরীরটা ভালো নেই। বাড়িতেই সব করছি।
দেখবে নাকি পত্রিকাটা?
মনীষ কী বলবে ভেবে পেল না। সে বলল, তুমি কি কাগজ পড়তে পছন্দ কর?
স্টেটসম্যান। এটাতে সঠিক খবর পাওয়া যায়।
একটু দেখলে হত।
এখন শান্তি কাগজটা খুঁজছে। আসলে কাগজটা সেও লুকিয়ে রাখে। একা পড়তে ওরও বোধহয় ভয় হয়। কোনোরকমে কিছুটা পড়েই রেখে দেবার স্বভাব। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে ভালো লাগে না। সে পত্রিকা খুলেই একটা খবর শুধু খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু খবরের শিরোনাম দেখলেই সে কেন সে সবটা পড়তে সাহস পায় না, শিরোনামটা পড়েই সে রেখে দেয়। তারপর সে ভাবে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের ওপর একটা বড় রকমের বক্তৃতা দেওয়া যাক। সে জানালায় দাঁড়িয়ে, কিছু পাহাড়—জঙ্গলের ছবি দেখতে পায়, একটা ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছে কারা দেখতে পায়, তখন মনে হয়, ব্রিজ উড়িয়ে দিলে দুটো—চারটে লাশ পড়বে, মরে থাকবে জঙ্গলের ভিতর, এবং এ নিয়মেই বিপ্লব সব জায়গায় হয়েছে। সে খানিকক্ষণ পায়চারি করতে থাকে, তারপর মনে হয় মৃত্যু একসময় হবেই, সে এ—জন্য বড় বেশি ভাবছে। এক কাপ চা দিতে বলে, সে আবার পত্রিকাটা খুলে পড়বে ভাবে, না, থাক, চা আসুক, চা খেতে খেতে পড়া যাবে। এবং এভাবে সে সেই একটা শিরোনামার সংবাদ যখন শেষ করে ফেলে তখন ঘড়িতে দশটা বাজে। কাগজ আসে সকাল সাতটায়। একটা শিরোনামা শেষ করতে ওর হয়ে যায় দশটা। সে একটা খবরই তারপর সারাদিন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়ে। পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে যায়। নানাভাবে সে দেখতে চায় মৃত্যুগুলোর সঙ্গে ওর জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক কতটুকু। যেমন বিজ্ঞান কলেজের একজন অধ্যাপকের গলা কেটে দেওয়া হয়েছে, সবটা কাটাতে পারেনি, ঘাড়ে রেজার চালিয়েছে। ঘাড়ে রেজার চালাতে কতটা গভীর ক্ষত হতে পারে, একটা না দুটো, কবার, এবং সে যদি এমন একটা সমস্যার সম্মুখীন হয় তবে কীভাবে সে ওদের সঙ্গে যুঝবে, ওর তো ইচ্ছা, সে সময়ই দেবে না। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেবে, না তার চেয়ে পেছন দিক থেকে লাথি, সে এ—ভাবে বসে থাকবে যাতে করে ওর গলাটা কেউ কাছে না পায়। সব হত্যাই এ ভাবে যখন হচ্ছে তখন একটা পাতলা লোহার চাদরে মোড়া বর্ম জামার নিচে থাকলে কেমন হয়, কোনো বিজ্ঞাপনদাতা এমন একটা বিজ্ঞাপনও কেন যে দিচ্ছে না, মধ্যযুগীয় নাইটদের মতো সে তবে বর্মের পোশাক পরে থাকত। সে মাঝে মাঝে পত্রিকার ভিতর বোধহয় এমন একটা বিজ্ঞাপনের খবরও পেতে চেষ্টা করে। আর এ—ভাবে এগারোটা বাজলে সে বুঝতে পারে, খবরটি শুধু ওর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়াই হয়নি, সেটা সে মুখস্থও করে ফেলেছে, তারপর সারাটা দিন, ঐসব নিহত মানুষের ছবি ওর চারপাশে ঘোরাফেরা করলে সে কেমন নিজেই পাগলের মতো জোরে জোরে কাকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা দিতে থাকে। এই এগারোটায় তার এক নম্বর বক্তৃতখানা আরম্ভ হবার কথা। মনীষ এসে কিছুটা অসুবিধা ঘটিয়েছে।