অথচ বাড়ি ঢুকেও সে কেমন শান্তি পাচ্ছিল না। সে সোজা সিঁড়ি ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল না। গাড়ি সদরে এলেই গেট ধীরে ধীরে খুলে গেল। সে সাধারণত গাড়ি সদরে রেখেই সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যায়। রসুল অথবা রাম অবতার সেলাম দেয়। গাড়ির দরজা খুলে দিলে সে বের হয়ে আসে। আজ একেবারে অন্যরকমের। সে সোজা গাড়ি ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। নিজেই গ্যারেজ করল গাড়ি। চারপাশে কী যেন খুঁজল। বোধহয় সে ও—পাশের গ্যারেজ দেখছে। গ্যারেজ বন্ধ। গাড়ি ভিতরে আছে না বাইরে, সে বুঝতে পারছে না। রসুলকে সে বলল, সাব ফিরেছে?
না দিদিমণি।
এখনও কেন ফিরল না! তারপর আর কিছু বলল না সোমা। সে ঘড়িতে সময় দেখল, বারোটা বেজে গেছে। ওরা একটায় খায়। একসঙ্গে খায়। কলেজ বন্ধ বলে সোমাকে এখন আর আগে খেতে হয় না। মনীষ অপিস থেকে টিফিনে ফিরে এলে একসঙ্গে খায়। সে হয়তো অপিসে আজ যাবে না। হয়তো শরীরটা ভালো নেই বলে ফোনেই সব কাজটা সেরে নেবে। দরকারি সইটই—এর জন্য ফাইল পাঠিয়ে দিতে বলবে।
সোমার ধারণা, মনীষ এক্ষুনি এসে যাবে। বরং এ—ফাঁকে স্নান সেরে ফেললে হয়। কিন্তু সিঁড়ির মুখে ওঠার সময় মনে হল ওদিকে একটা ফুলের টব কাত হয়ে পড়ে আছে। বিশ্রী লাগল। মনটা তিক্ত হয়ে গেল। বাগানের মালিরা কী যে করে। এখানে সদানন্দ কাজ করে, এই সব ফুলের টব সদানন্দের দেখাশোনা করার কথা। এ—ভাবে কিছু অবহেলায় পড়ে থাকলে ওর মাথাটা কেমন গরম হয়ে যায়। কিন্তু মনীষ ফেরেনি, সে না ফেরা পর্যন্ত ওর ভিতরের চিন্তাটা যাচ্ছে না। কাঠের সিঁড়ি বলে শব্দ হয়। সিঁড়ি ধরে কেউ উঠে গেলেই টের পাওয়া যায়। একসময় এই কাঠের সিঁড়িটার জন্য ভীষণ রাগ ছিল সোমার! কেমন পুরোনো সাবেকি ব্যাপার? সে, যা কিছু পুরোনো সাবেকি ব্যাপার সব সেকেলে ভেবে থাকে। কাঠের সিঁড়িটা না থাকলেই যেন ভালো হত।
কিন্তু এখন সে তেমন ভাবে না। এটা না হলেই খারাপ হত। কাঠের সিঁড়িটায় কেউ পা দিলেই বোঝা যায়, কেউ উঠে আসছে। যদি অঞ্জন অথবা অন্য কেউ উঠে আসে তবে ঠিক টের পাওয়া যাবে। শব্দ শুনলেই টের পাবে কেউ উঠে আসছে। আর এ—কাঠের সিঁড়িতে উঠে আসে মনোরমা। মনোরমা উঠে এলে টের পাওয়া যায় মনোরমা উঠে আসছে। রসুল উঠে এলেও টের পাওয়া যায়, রসুল উঠে আসছে, ওদের পায়ের শব্দ এক—এক রকম। আর উঠে আসতে পারে কারখানার বড় বাবু। সে লোকটা মনীষের সব। লোকটা মনীষকে পাতালে নেমে যাবার সোজা রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছে। কাঠের সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ একেবারে আলাদা। কেমন ঘষটে ঘষটে একটা শব্দ। একটানা, উঠছে তো উঠছে। বাতে পঙ্গু হলে মানুষ যেমন হয়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে, শব্দটাও তেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সারা বাড়িতে বলে দেয়, খোঁড়া লোকটা এখন কাঠের সিঁড়ি ভাঙছে। আর কারও উঠে আসার নিয়ম নেই। কেউ ওখানে পা দিতে পারে না। আর পারে অসিত। অসিত উঠে এলেও সোমা টের পায় অসিত উঠে আসছে। সুতরাং এ—সব শব্দ বাদে অন্য কোনো শব্দ হলেই মনীষ সাবধান হয়ে যেতে পারবে। সিঁড়িটা না থাকলে মনীষের পক্ষে এটা সম্ভব হত না।
সোমা এখন বাথরুমে। সে নানাবর্ণের সব সুগন্ধ জলে গুলে নিয়েছে। সে মুখে এবং হাতে পায়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে বেশ খোলামেলা আয়নার সামনে বসে রয়েছে। এই কাঠের সিঁড়িটা যা হোক একটা কানের কাজ করছে। মনীষের হয়ে বলে দিচ্ছে কে আসছে, এমন বিশ্বস্ত কাঠের সিঁড়ি। এখন আর তাকে সে সেকেলে অথবা পুরোনো আসবাবপত্রের মতো ভাবতে পারে না। বরং এ—বাড়িতে রসুল, রাম অবতারের মতো, বিশ্বাসী সৎ, ওরা নিদারুণভাবে গেটে থাকছে। যদিও সোমা জানে, যাদের আসার কথা, তারা গেট দিয়ে আসে না। গেট দিয়ে এলেও কেউ তাদের আটকাতে পারে না। সে কাগজে এমন কত খবর পড়েছে। ওর কেমন এই বাথরুমে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, আসলে সোমার বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় এমন একটি সুন্দর জায়গা। প্রায় চারপাশে লালবর্ণের কাজ করা পাথর বসানো দেয়ালে, আর দেয়াল জুড়ে আয়না। হেঁটে বেড়ালে বেশ লাগে। একটা শোবার ঘর এখানে ঢুকে যেতে পারে। আসলে সোমা এখানে এলেই নিজেকে চিনে ফেলতে পারে। সে তার শরীর চারপাশ থেকে তখন আয়নায় দেখতে পায়। শরীরে কী আছে, এবং সুন্দর স্তন, জঙ্ঘা কী যে পুষ্ট আর মনোরম, সে নিজের ছবিতে নিজেই কেমন তন্ময় হয়ে যায়—সেখানে দুটো মাত্র চোখ, এবং সহসা সে এটা কী দেখে ফেলছে, আয়নায় ওর, মাঝে মাঝে সেই চোখ দুটো, হুবহু, সেই পত্রিকার মুখ, হুবহু এক, এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে। সোমা চিৎকার করে উঠল, মনীষ, সে আসছে, সে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ ঘোলা হয়ে গেল। সে চারপাশে অন্ধকার দেখতে থাকল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
বারো
শান্তিবাবু দরজায় কেউ কড়া নাড়লেই কেমন হয়ে যায়। অবিবাহিত মানুষ। মা আছেন। আর একটা চাকর। তিন তলার ফ্ল্যাট। ইতিহাসের অধ্যাপক। ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসটা বোধহয় খুব ভালো পড়া ছিল না, হলে একটা লিস্ট টানিয়ে দিতেই এত ভয় পাবার কথা না। প্রথমে নামটা দেখে ভেবেছিল, ভুল, ছাত্ররা তাকে ভীষণ ভালোবাসে, কিন্তু চোখ মেলে ফেরতাকালে বুঝেছিল, না ভুল নয়, ওরা ঠিকই ওর নাম লিখেছে, তবে ভালোবাসে বলে, একেবারে শেষে বোধহয় নামটা রেখেছে।