দেখলি তো আমাকে ও কী চোখে দেখে!
বিনু বলল, আমি সত্যি আত্মহত্যা করব সোমা। আমি লিখে রাখব, এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী সোমা। বালিশের তলায় রেখে গেলে দেখবে কেমন মজা।
ও বাবা, দরকার নেই, আমি গেয়ে শোনাচ্ছি। সে দু’বার গলা সাফ করে বলল, আচ্ছা তোমরা কী! একটা সময় অসময় নেই? তোমরা কী সবাই পাগল?
এখন খুব সময় অসময় দেখানো হচ্ছে। আগে তো, এই সোমা গা না, ব্যাস, গান আরম্ভ হয়ে গেল। টেবিলে তাল দিচ্ছে নিশীথ। তোমার নিশীথকে মনে পড়ে সোমা?
খুব।
সে বেটা এখন কৃষ্ণনগরে পোলট্রি করেছে।
এই না সে বলত, আমেরিকায় যাবে ডক্টরেট করতে?
কেন, করেছে তো। পোলট্রিতে। নানা জাতের মুরগি ব্রিডিং করাচ্ছে। সুধীর জলের গেলাসগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে এমন বলল। বেটা সারাজীবন হাঁস—মুরগি ব্রিডিং করল। নিজের কিছু হল না।
কার কী হয়েছে? তোমরা বাদে কে কী ব্রিডিং করতে পারছে?
সোমা বলল, আমরা কিন্তু টেবিল ম্যানার্স মানছি না।
সুধীর বলল, আমরা ভুলেই গেছিলাম এখানে একজন মহিলা বসে আছেন। এবং তিনি আমাদের বন্ধুপত্নী।
বিনু বলল, সুধীর তোর মুখ বড্ড আলগা। আজ ক’টা উইকেট ডাউন রে?
সোমা বিনুর এমন কথায় নিজেকে খুব সেকেলে ভাবল।
শীত আরম্ভ হয়ে গেছে। এ—বছর বিদেশ থেকে কোনো টিম খেলতে আসছে না।
পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ে। রঞ্জি ট্রফি আরম্ভ হতে অনেক দেরি। হয়তো ইংল্যান্ড—অস্ট্রেলিয়ার খেলার কথা বলছে। কিন্তু সে যতটা জানে খেলা আরম্ভ হতে আরও সপ্তাহখানেক বাকি।
সুধীর বলল, আজকের খবর জানি না।
অশোক বলল, শুনেছি শোভাবাজারে সকালের দিকে ওয়ান উইকেট ডাউন খেলা চলছে।
কারা খেলছে?
বলা নিরাপদ তো? বলে সে চারিদিকে তাকল। যা আজকাল দিন যাচ্ছে।
সোমা খুব উদ্বিগ্ন মুখে তাকাল। বলল, কেন কী হয়েছে? বল না শুনি।
ভাই আমার চোখে দেখা নয়। শোনা। চিৎপুরে ট্রাম—বাস বন্ধ।
সোমা এবার বুঝতে পারল। কোন পার্টি কার বিরুদ্ধে খেলছে আজকাল সে—সব আর খুলে কেউ বলতে চায় না। মনীষ এমন লক্ষ্মীছাড়া দেশের যে কী হবে ভেবে মুখ উদাস করে রাখল।
আবদুল খাবার রেখে গেছে। ওরা চিকেন—প্যাটিস এবং ক্রিম কফি খাচ্ছে। তখনই মনে হল সোমার, কয়েকটা টেবিল পার হলে একটা গোলাকার টেবিলে চার পাঁচজন খুব নিভৃতে কী যেন আলাপ করছে। এবং সবচেয়ে উঁচু লম্বা যে মানুষটি ওর দিকে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে, সোমার মনে হল মানুষটাকে সে কোথাও দেখেছে এবং খুব চেনা। অথচ সে মনে করতে পারছে না সে কে। কোথায় কীভাবে আলাপ। সোমা একটুকরো প্যাটিস মুখে দিতে দিতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
এ—জায়গা খুব পরিচিত জায়গা। অন্যত্র হলে সোমা ভয় পেত। বারবার ফিরে ফিরে তাকানো ওকে কেমন বিব্রত করে তুলছে। এবং কিছুটা চুরি করে দেখার মতো ভাব চোখে। সোমাও যতটা পারছিল সবার অলক্ষ্যে মাঝে মাঝে সেদিকে তাকাচ্ছে। এবং সেই চোখ যা তাকে কোনো দূরাগত স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে চাইছে।
বিনু বলল, আমাদের কিন্তু সেই গানটা এখনও শোনা হল না।
সোমা বলল, আমার ভালো লাগছে না। সোমার চোখ—মুখে এমন মায়া মাখানো যে বিনু আর ওকে অনুরোধ করতে পারল না। শুধু বলল, সোমা, আমরা বেশিদিন আমাদের মুক্ত জীবনকে ধরে রাখতে পারি না।
অশোক বলল এই আরম্ভ হয়ে গেল নীতিবাক্য।
না রে নীতিবাক্য নয়। ভেবে দেখ তো কী সুন্দর ছিল সেইসব দিনগুলো।
সোমা বলল, আমরা যে যার বাড়ি থেকে কত মিথ্যা কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য বের হয়ে গেছি। রোদ জল ঝড় মানিনি। ফিরতে রাত হয়ে গেছে। মাকে একবার সাপ্টে ধরে গালে চুমু খেলেই মা—র রাগ সব জল! কী বাবা দস্যি মেয়ে, মা বলত। একবার মনে আছে মনীষ, তোমরা আমাকে ম্যাড হাউসে নিয়ে গিয়েছিলে। জোর করে প্রথম এক পেগ জিন খাওয়ালে লাইমজুস দিয়ে, কী আমার ভয়, কিন্তু বাড়ি গিয়ে স্রেফ বলে দিলাম, মাথা ধরেছে কিছু খাব না। পার পেয়ে গেলাম। বেশ স্বপ্নের মতো মনে হয় দিনগুলো।
তা মনে হবে না কেন? মনীষ বলল, চারপাশে বন্ধুজন, বান্ধবী এবং উড়ে বেড়ানো। মেয়েদের তো ঐ স্বভাব, মধুটি খাব, কাঁটার ঘা—টি খাব না।
বাজে বকো না, সোমা এমন ভর্ৎসনার সুরে বলল। কেবল মেয়েদের বেলায় এটা খাটে না। তোমরাও কম যাও না বাপু। বলেই সোমা তাকাল দূরের টেবিলে, দেখল মানুষটা তাকে আবার চুরি করে দেখছে।
এখন আমরা উঠব। সোমা বলল।
এত তাড়াতাড়ি?
না রে, দিনকাল বড় খারাপ। আটটা বাজতেই রাস্তা ফাঁকা।
অশোক বলল, কী বই দেখলি?
মহান পরিচালকের বই।
কেমন দেখলি?
মনীষ তাকাল সোমার দিকে। খুব ভালো। সোমা কিছু হয়তো বলবে এ—ব্যাপারে। কারণ সোমার ভালো লাগেনি। ওর বোর করেছে। কিন্তু সোমা কিছু না বলতে সে কেমন উৎসাহ পেয়ে গেল। সে বলল, বোঝা যায় ফিল্মের যে আলাদা একটা ল্যাঙ্গোয়েজ আছে। সে তার নিজগুণেই ভাস্বর।
যা ব্বে? সুধীর কেমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। তুই কবে থেকে আবার ফিল্ম ক্রিটিকের কাজ নিলি? শুনেছি তো ক্যাপিটালিস্ট বনে যাবার জন্য দিন—রাত উইকেটে দাঁড়িয়ে বেমক্কা খেলে যাচ্ছিস।
ফিল্ম—ক্রিটিকের কী আছে। তবে সাধারণ দর্শকদের ভালো নাও লাগতে পারে।
ওরা একটা নিটোল গল্প খুঁজতে চায়।
সে গল্পটা বল। সোমা মুচকি হাসল।
মনীষ কিছুতেই বলতে চাইছে না। সে বলল, ওদের কথা বাদ দাও। ওরা এসেছিল খুব একটা মারামারি, অথবা নিটোল প্রেম, কিংবা হত্যা রাহাজানি এসব দেখবে বলে।