সে তো সবাই চায়, কেউ পায় না।
তোর না পাওয়াটা একটু বেশি।
তা বলে, তুই কী বোঝাতে চাস!
এ—ভাবে আর কাউকে খুঁজিস না। এতে বিড়ম্বনা বাড়বে।
সোমা মনে মনে রাগ করতে পারত। সে রাগ করল না। সে জানে বিনু আন্তরিকভাবেই সব বলে যাচ্ছে। সোমার মতো মেয়ের এ—ভাবে ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। সোমা বলল, আমার যে কী হয়েছে।
—কিছুই হয়নি। আসলে তুমি ভয় পেয়ে গেছ। ভিতরে ভিতরে মনীষের কাজকর্ম তুমি অনেকদিন থেকেই অপছন্দ করছ। তুমি দেখতে পাচ্ছ, যা তুমি ঘৃণা করতে, এখন মনীষ তাই করছে। যার বিরুদ্ধে লড়বে বলে তুমি মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখেছ, ঠিক সেই পাপ মনীষ করছে।
না। মনীষ কোনো পাপ করেনি।
এমন কথায় কি তুমি রাগ করছ!
রাগ, নিশ্চয়ই। তুমি কী বলতে চাও এ—সব।
ভুল হলে ক্ষমা করে দেবে! বিনুর চোখ দুটো কেমন ছলছল করতে থাকল। সে কেমন থেমে থেমে বলল, আসলে আমারও মাথা ঠিক নেই, রমুর জন্য আমাদের সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কত আশা ওকে নিয়ে। সে এখন বাড়ি আসে না। পুলিশ ওকে খুঁজছে। যেখানে পাবে, শেষ করে দেবে।
সোমা কেন যে বিনুর দিকে সহজভাবে আর তাকাতে পারছে না। বিনুর সেই চঞ্চল চোখ দুটো আর খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে বিনুই কী কখনও তাকে বলেছিল, কাজল পরলে তোমাকে ভালো লাগে না, বিনু আর মনে করতে পারছে না কথাটা, উলটো কথা বলছে, এ—ভাবে যা হয়ে থাকে মাথা গণ্ডগোল হয়ে যায়, যার কথা মনে হয়, সেই শয়তান ব্যক্তির কথা মনে হয়, বাবার তেলেভাজা খাবার নিদারুণ ইচ্ছার কথা মনে হয়, এবং সারাক্ষণ যেন বাবা সেই লোকটার ভয়ে হে হে করে হেসে যাচ্ছে। কান্না পেলেও কাঁদতে পারছে না, বিনুই কী তখন বলেছিল, আমাদের এ—সমাজ বদলে দিতে হবে। না অশোক, না সেই নিতাই! কে? কে বলেছিল! এবং সে এখন কিছুই মনে রাখতে পারছে না, এবং সেই চোখ দুটো, অথবা অঞ্জন, অথবা কাগজের ছবি সব মিলে কেমন সত্যি ওর মাথাটা গণ্ডগোল করে দিচ্ছে। ভোর রাতে সে কাকে যে দেখল গাড়ি বারান্দার ছাদে। সে সম্পর্কে বিনুকে আর কেন জানি কিছু বলতে ইচ্ছা হল না। সে উঠে পড়ল। সে বিনুকে বলতে পারল না, মনীষ পাকা কাজ করছে। কোথায় যে তার অহংকারে লাগছে। বলতে পারলে যেন হালকা বোধ করত।
সে গাড়িতে এবার কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়াল। যেমন সে বিনুদের বাড়ি থেকে বের হয়ে, সোজা মাণিকতলা, তারপর বড় রাস্তা ধরে কাঁকুড়গাছি, উল্টোডাঙা, লেক—টাউন, দমদম পার্ক পার হয়ে যাচ্ছে এবং জোরে গাড়ি চালাতে ইচ্ছা হচ্ছে। অথচ সে ঠিক বুঝতে পারছে না কিছু। এমন সুন্দর বাড়িটা কেন যে ক্রমে একটা রহস্যময় বাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এখন তো মনীষ বাড়ি নেই। সে ভয়ে হয়তো দু—একদিনের ভিতর বাড়ি ছেড়েও দিতে পারে। যেমন ভয় পেয়ে অনেকে, দিল্লি অথবা এলাহাবাদ, কেউ আবার পুণা, অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতের কোনো নিরিবিলি জায়গায়, আত্মগোপন করে থাকছে। এবং যেভাবে মনীষ ত্রাসের ভিতর পড়ে গেল, সেও ঠিক পালাবে শেষ পর্যন্ত। সে গেলে তাকেও যেতে হবে, কিন্তু সেই লোকটাকে তো কলকাতার বাইরে গেলে পাওয়া যাবে না, সে তো কথা আছে, বড় মাঠে আসে। বুড়ো মানুষটাকে আগুন জ্বালাবার জন্য খড়কুটো সংগ্রহ করে দেয়।
ওর চুল উড়ছিল। সে খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে না। ওর পাশ দিয়ে বাসগুলো বেশ জোরে বের হয়ে যাচ্ছে। এমনকি, সব গাড়ি ওকে ফেলে সামনে চলে যাচ্ছে। সে কিছু ভাবছে না। সে দেখছে চারপাশে সব বাড়ি ঘর, এবং বড় বড় ইলেকট্রিক পোস্ট, অথবা কখনও বিজ্ঞাপনের বড় বড় ছবি, সে এ—ভাবে কেন যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আসলে সে বোধহয় ঘুরে বেড়াচ্ছে না, সে নিজের ভিতর ডুবে যেতে চাইছে, এবং অন্যমনস্ক হলে ভীষণ কেলেঙ্কারি, একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। অঞ্জন বলে সে কাউকে চেনে না, অঞ্জন বলে তার কেউ জানা নেই, সে অহেতুক ঘুরে মরছে। তার চেয়ে বরং সে ভাবল, বিকেলে, ভালো একটা ছবি দেখবে, মিডনাইট কাউ বয়, খুব আশ্চর্য ছবি, এমন ছবিতে বসে থাকলে, অহেতুক সে ভাবে না। ছবিটার নাম সে শুনেছে, বেশিদিন থাকছে না। টাইগারে হচ্ছে। টাইগার হলটা বাজে। সেখানে সে যেতে পারে না। সে যে কী করে। সে বড় বড় সব হাউসে ছবি দেখে থাকে। সাধারণ ছবি—ঘরগুলো সম্পর্কে আজকাল কোনো খবর রাখে না। কিন্তু টাইগার ভীষণ বাজে ব্যাপার। সে একবার লুকিয়ে, কে কে সঙ্গে ছিল, বোধহয় নিতাই, অবনী এবং অন্য অনেকে। বিনু ছিল না, মনীষও ছিল না, এটা সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে। দলটা ভারী ছিল। একমাত্র মেয়ে সোমা। ওর প্রতি সবাই মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল এটা মনে আছে। সেখানে কী অঞ্জন নামে কেউ ছিল! যে একবার এসেই চলে গেছে, আর আসেনি। ওর উজ্জ্বল চোখ দুটো কেবল সে মনে করে রেখেছে। মনের ভিতর চোখ দুটো এতদিন আত্মগোপন করেছিল, কফি—হাউসে তাকে দেখার পর আবার সে ভেসে উঠেছে!
কী যে হয় তারপর। কপাল ঘামতে থাকে। সে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরে হাওয়া ঢুকছে। চুল ফুরফুর করে উড়ছিল। সে খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। সাদা রঙের গাড়ি, আর ভেতরে একমাত্র যুবতী সোমা। চুল এলোমেলো। খোঁপা বাধা নেই। খোলা। উদাসীনতা চোখে মুখে। কী অঞ্জনকে যথার্থই খুঁজে বেড়াচ্ছে, না মনের ভিতর এমন একজন মানুষ থাকে, যে রাজার মতো, যাকে সবসময় ঠিক খুঁজে পাওয়া যায় না—এবং এ—ভাবে কী যে হয়ে যায়, সোমার সুন্দর চোখে এক অপার্থিব করুণা ভেসে ওঠে। চারপাশে এত সব গরিব মানুষেরা রাস্তায় শুয়ে থাকে, ওর মনে হয়, এটা একধরনের পাশবিকতা, এ—ভাবে এদের চোখের ওপর গাড়ি চালিয়ে যাওয়া সত্যিই বড় বেমানান। সে সোজা বাড়ির দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল। চারপাশের এমন সব দৃশ্য ওর কেমন অসহ্য লাগছে।