কে আবার ডাকবে! আমি বললাম, বিনু চিনতে পেরেছিস?
অঃ তুই। আচ্ছা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
তা হলে দে। বলেই সোমা উঠে দাঁড়াবে ভাবল।
ছবিটার জন্যে এখানে ছুটে এসেছিস!
সে তুই বুঝবি না!
আচ্ছা এ—ছবিটার সঙ্গে কী সেই মানুষটার মিল আছে?
হুবহু এক।
কী যে মিস করলাম!
মিস করলি মানে!
তোকে দেখছিল, আমরা দেখলাম না, তোকে কে এত দেখছিল! মিস করলাম না!
এখন আজে—বাজে কথা রাখ। কী করি বলত!
তোর আবার কী করার আছে! সুন্দরী মেয়েদের অনেকেই দেখে থাকে। তোকেও দেখেছে। অঞ্জনের খোঁজখবর করতে পারলি?
না।
তোর যে কী হয়েছে! অবশ্য এমন হয়েছে আজকাল। সব মানুষই পাগল হয়ে যাচ্ছে। বিভীষিকা! আমাদের বাড়িতেই দেখ না, একটা আতঙ্ক সব সময়। কখন খবর আসবে, রমু হাসপাতালে, অথবা সে কী বলতে গিয়েও থেমে গেল। বলল, না থাক। ও—সব ভাবলে মাথা ঠিক থাকে না। আমার মতে এখন কারও সঙ্গে কথা বলা ঠিক না। চুপচাপ থাকা ভালো। মাও বোধহয় কিছু দেখতে পায়। রমুরা সবুজ মাঠে শুয়ে আছে দেখতে পায়।
সোমা বলল, চিনতে পারলি না?
না।
তবে যাচ্ছি।
বোস। গরিবের বাড়িতে একটু চা খেয়ে যা।
সোমা কী ভেবে বলল, তাড়াতাড়ি। আমি বসব না।
কোথায় যাবি?
দেখি, আর কেউ চিনতে পারে কি না!
কেউ চিনতে পারবে না। অনর্থক ঘুরে মরবি।
কিন্তু আমার কী মনে হয় জানিস, অঞ্জন আর এ লোকটি একই ব্যক্তি। জায়গায় জায়গায় নাম ভাঁড়াচ্ছে।
তা হতে পারে।
সে আবার কবে আসবে লিখেছে?
কবে আসবে কিছু লেখেনি।
বেশ ফাজিল ছোকরা।
মানে!
মানে, আমার যা মনে হয়, বড়লোকের এমন সুন্দরী বউ দেখেই একটু মসকরা করছে। আর এমন সুন্দর মেয়ের স্বামীকে কেউ মেরে ফেলতে পারে না।
তুই কী আজেবাজে বকছিস!
আজেবাজে নারে। আমি তো মানুষ চিনি। সবাই তো তোদের মতো জায়গায় যেতে চায়। যেতে ভালোবাসে। যেতে না পারলে আক্রোশ হয়। তখন সব ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। কিন্তু একবার পৌঁছে গেলে, আর মায়াবী ছবির মতো তোর মুখ দেখে ফেললে কেউ আর নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতে পারে না। মনীষের কিছু হবে না। তোরা অনর্থক উদবিগ্ন হচ্ছিস!
সোমার ইচ্ছা হচ্ছিল, ভোর রাতের ঘটনা খুলে বলে। সব খুলে বললে, বিনু বুঝতে পারবে, কেন সে এমন অসহায় বোধ করছে। কিন্তু বিনুকে সে আর কিছু বলতে উৎসাহ পেল না। কারণ বিনু খুব সিরিয়াস না এ—ব্যাপারে। চারপাশে এমন হচ্ছে, বড়লোকের শখের ব্যাপার, একটু ভয় পাওয়া। ওদের গায়ে তো কেউ হাত দিচ্ছে না, এটা পাড়ার কোনো ফাজিল ছোকরার কাজই হবে, কারণ বিনুর কথাবার্তায় মনে হয় ফাজিল ছোকরাটি সোমার জন্য ঘুমোতে পারে না। বড় বড় শ্বাস উঠে আসে। এমন একটা দুঃসময়ে ভয় পাইয়ে দিতে পারলে বেশ মজা। এবং এ—ভাবে এক চিঠি, সুতরাং সোমার এ—সব ভয় বিনু খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভেবে নিচ্ছে।
সোমা বলল, যাই রে।
চা এসেছে। চা না খেয়ে যাবি!
শুধু চা।
শুধু চা—ই দেওয়া হচ্ছে।
সোমা চা খেতে খেতে বলল, সবকিছুই বিনু হালকাভাবে নিলি?
না নিলে ভীষণ দুঃখ পেতে হয়।
তাহলে সবই তুই ভুলে গেছিস?
দুম করে সোমা এমন কথা তুলে ফেলবে সে ভাবতে পারেনি। বিনু বলল, ও—বয়সে এমন হয়। ওটা কিছু না।
চার বছরে তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ ভাবছ।
সত্যি অনেক বড়। চার বছরে কত কিছু জেনে ফেলেছি। তুই কিন্তু আজও চোখে কাজল দিলি না। কাজল দিলে তোকে বড় ভালো লাগত।
সোমা ওকে এখন তুমি তুমি করছে। বিনু সোমাকে এখনও তুই—তুকারি করছে।
সোমা বলল, কে যেন আমাকে বলেছে, সোমা তুমি কাজল পোরো না, কাজল পরলে আমার ভালো লাগে না।
সে কে!
কখনও মনে করতে পারি, কখনও পারি না। একসময় মনে হয়, যাদের ভালো লাগত, তারা সবাই আমাকে এ—কথাটা বলেছে।
তা হলে তুই বলছিস, আমাকে তোর ভালো লাগত না!
কী জানি, বুঝতে পারি না।
আমি তোকে কাজল পরতে বলতাম। কাজল পরলে তোকে খুব মায়াবী দেখাত।
সোমা বলল, কাজল না পরলে আমাকে খুব ইননোসেন্ট দেখায়, কে যেন বলত!
আমরা কেউ ইননোসেন্ট নই সোমা।
এখন মনে হচ্ছে।
অথচ দ্যাখ, কলেজ লনে আমরা কত সব বড় বড় আদর্শের কথা বলতাম!
সবাই না।
সবাইর মনে কিন্তু একটা স্বপ্ন ছিল। যেন, পৃথিবী এক আশ্চর্য জায়গা, যাও, বড় হও, ধর্মপ্রচার করো।
এখনও তো তাই আছে।
ঠিক বলছিস তাই আছে!
মনে তো হয়।
তবে তাকে খুঁজছিস কেন?
তাকে মানে?
এই যে কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস। অঞ্জন না কী নাম!
কী যে বাজে বকিস না! আবার সোমা তুই—তুকারিতে ফিরে এল। চিঠি দিয়ে যে ভয় দেখিয়েছে, সে তো সেই লোকটা।
তোর কী মনে হয়, কফি—হাউসের লোকটাই অঞ্জন হবে।
হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
যদি খুঁজে পাস, কী করবি?
সোমা এ—কথার জবাব দিতে পারল না। সত্যি তো খুঁজে পেলে কী করবে! সে তো এটা ভাবেনি। সে তো ভেবেছে, যে লোকটা ওর দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল, যে চোখ দুটো ভীষণ চোখ, এবং ছবির চোখের সঙ্গে হুবহু এক, আর নাম লেখা আছে অনিমেষ, সেই কী অঞ্জন, সে কি সেই, যাদের সে ভাবত, পৃথিবীতে তারা অনেক বড় হবে। সে ভাবত, সে থাকবে, ওদের পাশে। এখন যদি খুঁজে পায়, তবে তার সঙ্গে সে কতদূর যেতে পারবে! সোমা বিনুকে কোনো জবাব দিতে পারল না।
বিনু বলল, একটা কথা বলব সোমা?
কী কথা?
আমি জানতাম, তুই কিছু জবাব দিতে পারবি না। তুই বড় হতে হতে অনেক কিছু চেয়েছিলি—মনে হয় সব পাসনি।