একটা শো দেখতে এসেছিলাম। অনেকদিন পরে আসা, তাই ও বলল, দেখি আমাদের পুরনো বন্ধুবান্ধব কে আর এখন এখানে আসছে। সে অশোকের কথা গায়ে মাখল না।
ভালো করেছ এসে, অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম।
অশোক কী ওর সেই বিসদৃশ ঘটনা এখন বেমালুম ভুলে গেছে! ওর তো এখন শুধু সেই ঘটনার কথাই মনে হবার কথা। সোমা আজ অশোকের ওপর আর রাগ পুষে রাখেনি। কারণ সে দেখেছে মেলামেশার সুযোগে কেউ একটু বেশি চালাকি করে ভালোবাসা করে, কেউ কম। অশোককে সোমার এখন বরং বোকাই মনে হয়। বলে কয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা অশোকের ছিল না। অশোকের সহিষ্ণুতা ছিল না। ধুম—ধাড়াক্কা সে কিছু না বলেই সবটা করতে চেয়েছিল। তাকে সেদিন সোমার ইতর এবং ফাজিল মনে হয়েছিল। বলেছিল অশোক তুমি এমন ইতর, নীচ, জানতাম না।
অশোক সেদিন কিছু বলেনি। সে মাথা নিচু করে বসে ছিল। একটা কথাও বলেনি। সোমা খাবার ফেলে চলে এসেছিল। বিয়ের পর সে বুঝেছে মনীষও এটাই চেয়েছে। মনীষ ভালোবাসার ব্যাপারে শুধু সহিষ্ণুতা বেশি।
বিনু বলল, তা হলে অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।
সুধীর সোমার দিকে তাকাল।
ভয় নেই। যতটা খুশি দিতে পার।
সবাই এবার নড়েচড়ে বসল। মনীষ সবার বড় এমন একটা ভারিক্কি চালে বসে রয়েছে। কারণ এই চারজনের ভিতর সে—ই মোটামুটি এই ভালোবাসার ব্যাপারটাতে কী রহস্য আছে সব জেনে ফেলেছে। সে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, রমেশ দিল্লিতে বড় একটা চাকরি নিয়ে চলে গেছে।
ও শালা কেরিয়ারিস্ট। ওর কথা তুলে আর আমাদের এমন ভালো দিনটা মাটি করে দিস না মনীষ। সুধীর এটুকু বলে কী বলবে ভেবে একবার সোমার দিকে তাকাল, পরে মনীষের দিকে। ওর যেন মনীষকেই কিছু আঘাত দিতে ইচ্ছা করছে। বলতে ইচ্ছা হচ্ছে মামার দৌলতে তুমিও কম যাও না। কিন্তু সোমা সহসা একসঙ্গে এতটাকা খরচ করতে রাজি হয়েছে, এমন একটা খাবার টেবিলে আর হোস্টকে বিব্রত করে লাভ নেই। সে বলল, তুই নিতাইয়ের খবর জানিস?
না।
সে আত্মহত্যা করেছে।
বলিস কি!
সোমা বলল, আত্মহত্যা কেন?
আত্মহত্যা কেন সে তো সে বলতে পারবে।
এমন মানুষ কখনও আত্মহত্যা করতে পারে!
পারে। সব পারে, মনীষ খুব উদাসীন গলায় বলল।
সোমা বলল, ও তো কাজলকে বিয়ে করেছিল না?
একটা ছেলেও হয়েছে। বিনু বলল।
আহা রে! সোমার মুখটা যথার্থ খুব উদ্বিগ্ন দেখাল।
অশোকের এ—সব মৃত্যু—ফিত্যুর কথা শুনতে আদৌ ভালো লাগে না। চারিদিকে এখন অরাজকতা, রোজ মানুষ খুন হচ্ছে, বারাসতে এগারো জন, সকালে উঠেই এসব দেখতে দেখতে সে ভিতরে বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে থাকে। এখানে সারাদিন পর আসা একটু রিলিফের জন্য। বাড়িতে একগাদা ভাই—বোন। সে স্কুলে যতক্ষণ থাকে শান্তি, এখন আবার সে স্কুলও কর্তৃপক্ষ রোজ রোজ বোমাবাজির জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। কী করে যে দিনটা কাটে তার! সে বলল, স্রেফ আমরা খাব আর সুখের গল্প করব। এত দুঃখ চারিদিকে যে তাকানো যায় না। এখানে এসেও যদি তোমরা আত্মহত্যা—ফত্যা নিয়ে কথা চালাচালি কর—তো উঠে যাব।
ঠিক আছে বোস। মনীষ বলল। কেউ আর এ নিয়ে আলোচনা করবে না। তুই কি এখনও সেই জে.এন.অ্যাকাডেমিতেই আছিস?
কী করব ভাই। চেষ্টা তো করলাম। সুরেন্দ্রনাথে নাইটে একটা পার্ট টাইম হবার কথা ছিল। সে পর্যন্ত হল না। ওরা এইসব আন্দোলনের একটা কিনারা না হলে কিছু করছে না।
অশোককে দেখলেই মনে হয়, সে স্কুলের শিক্ষক বলে কেমন এখনও একটু মনমরা হয়ে আছে। আর সবাই কলকাতার কাছাকাছি কলেজে চাকরি পেয়ে গেছে। সে কোনো কলেজে কিছু করে উঠতে পারল না।
সোমা বলল, তাহলে অশোক তুমি একটা জায়গায় আছ?
অশোক বলল, তা আছি। কখন প্রাণটা যায়। তোমাদের কলেজে কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে না?
হচ্ছে না আবার! পরীক্ষা বন্ধ। বড়দি দুবার চেষ্টা করতে গিয়ে ভীষণ নাজেহাল হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি পারবেন না। কর্তৃপক্ষ স্কুলে পুলিশ পাহারা দেবে বলেছিল। তিনি রাজি হননি।
যা চলেছে!
আমরা কিন্তু আবার সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছি। মনীষ সবাইকে মনে করিয়ে দিল।
বিনু বলল, আমি, সোমা তোকে একটা অনুরোধ করব। রাখবি?
কী অনুরোধ? বলে সোমা মুখ থেকে চাদর নামিয়ে দিল। বিনু এতক্ষণ পর ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছে। বড় সুন্দর ঢলঢলে মুখ। বলল, তুই চোখে কোনোদিন কাজল দিলি না।
ও, সেই কথা?
না, সে কথা নয়। সেই গানটা গাইবি গুনগুন করে, আমরা সবাই শুনব।
কোন গানটা?
এখন নিজের ছায়ায় রচিছে কত মালা…। বড় ভালো লাগত এ—গানটা।
এটা কী গান গাইবার জায়গা?
তোকে জোরে জোরে গাইতে বলছি না। গুনগুন করে গাইবি। আমরা চুপচাপ কান পেতে শুনব।
বাড়িতে আয় না! কত গান শুনতে পারিস দেখব।
সে যাব’খন একদিন।
হয়েছে। কতবার বলেছিস, যাবি। কোনোদিন গেলি না।
যাব এবার ঠিক যাব। গাইবি?
না। এখানে গান গাওয়া যায় না।
মনীষ তুই বলে দেখ না।
তোর কথাই শুনছে না, আর আমার কথা শুনবে?
আবদুল জল রেখে গেল। বিনু অপলক দেখছে সোমাকে। ওর অনুরোধ রাখল না বলে কেমন দুঃখী মুখ নিয়ে বসে রয়েছে। মনীষ সে দুঃখ দেখে বলল, সোমা তুমি গেয়ে শোনাও না গানটা। তা না হলে, আবার একটা আত্মহত্যার খবরপাবে। পুলিশ ধরতেই পারবে না কেন সে আত্মহত্যা করল। মনীষ ব্যবহারে সব সময় ওদের খুব কাছাকাছি আসতে চাইল।
সোমা বলল, কী বাজে বকছ!