সোমার মুখটা ব্যথায় নীল হয়ে গেল।
কী সুন্দর ছেলে দুটো। তাজা। একেবারে ফুলের মতো তাজা। গলগল করে রক্ত পড়ছে। পুলিশ গলায় গুলি চালিয়েছে।
সোমা আর কথা বলতে পারল না।
ওদের কে যে এমনভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে বুঝি না। ওরা দুজন একজন সার্জেন্টের গলা কেটে ফেলেছিল।
সোমা বলল, তুমি খাও। আমার ভালো লাগছে না ওসব শুনতে।
বিনু বলল, আমি তাড়াতাড়ি চলে যাব। তুমিও তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। কখন কোথায় কীভাবে গণ্ডগোল বেধে যাবে বুঝতে পারবে না।
সোমা এবারও কোনো কথা বলল না। সে চারপাশে কাকে খুঁজছে। সোমা উঠছে না বলে সে—ও উঠতে পারছে না। সোমা কথাবার্তা আরম্ভ করল। সুধীর, অশোক এল না?
সবাই তো ভয়ে মরছে। এদিকে আসা সবাই এখন ছেড়ে দেবে। সাতটার পর রাস্তা ফাঁকা। তোমার কী মনে হয় এদেশে সিভিল ওয়ার শুরু হবে?
জানি না। ওর সঙ্গে দেখা হলে তোমাকে সব বলে দিতে পারতাম। সে বলল, অবশ্য মনে মনে। বিনু, আমার স্বামী মনীষ। সে এখন কত বড় ঘুষে কত বড় ইমপোর্ট লাইসেন্স দিল্লির উদ্যোগভবন থেকে বের করতে পারে তার মুসাবিদার জন্য ছুটোছুটি করছে। সে সংসারের এই অমঙ্গলের দিকটা দেখতে পাচ্ছে না।
বিনু বলল, তুমি কিছু ভাবছ সোমা?
কী ভাবব?
এই যে লক্ষ লক্ষ বেকার, আমার ভাইটা আজ চার বছর এঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বসে আছে। এখন বাড়ি থাকে না। রাত করে ফেরে। আমরা বাড়ির সবাই ওর জন্য রাত জেগে থাকি।…কেবল মনে হয় আমার ভাইটাকে কেউ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে কে সোমা?
সোমা বলল, তুমি উঠবে বলেছিলে, চল উঠি।
তুমি একা এতদূর যাবে? সঙ্গে যাব তোমার?
না। বরং চল আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাই।
না, সে কী করে হয়।
কী করে হয় দ্যাখো। বলে জোর করে সে বিনুকে গাড়িতে তুলে নিল। বলল, জান বিনু, আমাদের দেশের এই অবস্থা চোখে দেখা যায় না।
তুমি এমন কথা বলছ!
খুব খারাপ লাগে। রাতে একটা ভিখারি মেয়ে আমাদের বাড়ির নিচে রোজ পড়ে আছে দেখতে পাই।
তা খেতে না পেলে কী করবে? আশ্রয় না থাকলে যাবে কোথায়?
সে আজ হোক কাল হোক মরে যাবে।
তা যাবে।
মনীষকে মাঝে মাঝে বলি, এত দিয়ে আমাদের কী হবে?
কী কথায় কী কথা! বিনু বলল, মনীষের সঙ্গে তোমার রাগারাগি হয়েছে সোমা? আমি কাল যাব।
আমি রাগ করি না। কারণ রাগ করে আর লাভ নেই। আমরা দিন দিন একচক্ষু হরিণ হয়ে যাচ্ছি।
তারপর সোমা আর কথা বলল না। মানুষজন পাতলা। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। একটা বস্তির মতো জায়গার কাছে সোমা বিনুকে নামিয়ে দিল। বস্তির ভিতর দিয়ে বিনুকে যেতে হয়। সে যেতে যেতে মানুষের অসন্তোষ চারপাশে ফেটে পড়ছে দেখতে পেল। কারণ একটা কলের গোড়ায় আট—দশ তরুণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটি খুঁড়ছে। বিনুর মনে হল ওর ভাইটা ওদের ভিতর আছে। তাকে ডাকতে পর্যন্ত বিনুর সাহসে কুলাল না।
সোমা একা একা যাচ্ছে। এত বড় কলকাতা নগরী, ট্রাম বাস অজস্র মানুষ, আর তাদের সেই অসন্তোষ, যেন সবাই ফেটে পড়বে—বলবে, আমরা এ চাই না, আমরা অজস্র এই তরুণের মৃত্যু চাই না—তখন সোমা জানে, তার স্বামী, মনীষ, বাজারে তেলের অভাব, সে হোয়াইট অয়েল প্যাক করে কেমিক্যাল ঘ্রাণ মিশিয়ে বাজারে নারকেল তেল বলে চালাচ্ছে। মনীষের কাছে লক্ষ লক্ষ টাকা হাওয়ায় উড়ছে। কেবল কুড়িয়ে নিতে জানা চাই।
মনীষ কিছুতেই কেন জানি সংসারের অমঙ্গলের দিকটা দেখতে পাচ্ছে না। সোমার চোখে জল চলে এল।
সাত
কে যেন হেঁকে যাচ্ছিল তখন, গ্রামে গ্রামে আজ নতুন দিনের ফসল উঠছে, যে যার ফসল ঘরে তুলে নিন।
সোমা গাড়ি চালাতে চালাতে সেই হাঁক শুনতে পেল। কে হাঁকছে। সে গাড়ি চালাতে চালাতে লক্ষ্য করল না, কেউ হাঁকছে না। রাস্তার মানুষের ভিতর তেমন কেউ মানুষ নেই যে এমন হাঁকতে পারে। সবাই বাড়ি যাবার জন্য ছুটছে। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। চারপাশে কী হচ্ছে দেখছে না। বাড়ি পৌঁছে গেলেই যেন রক্ষা। তার তাকে কিছুতে পাবে না। সোমা এ—সময় মনে মনে না হেসে পারল না। আটটা না বাজতেই আবার গাড়ি—বারান্দায়, ফুটপাথে, গাছের নিচে সব অসহায় মানুষদের শুয়ে পড়ার দৃশ্য। সোমার মনে হল, সেইসব জায়গায় মানুষটা এখন অদৃশ্য হয়ে আছে, এবং হাঁকছে, যে যার ফসল ঘরে তুলে নাও।
সে একবার কুলু উপত্যকাতে বেড়াতে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে সোমা মোটরে যেতে যেতে কত সরাইখানা, নদী, মাঠ, পাহাড় দেখেছে। দেখেছে মাথার ওপর নীল আকাশ আর অজস্র পাখি এবং শীতের রোদ। সেই রোদে কত হাজার লক্ষ অসহায় মানুষের মুখ। দেখলে মনে হবে যেন কতদিন ওরা কিছু খায়নি। সোমার তখন আর উপত্যকার ফুল ফল নজরে আসেনি। বাবার মুখ মনে হয়েছে। বাবার আত্মহত্যার পরের মুখ। অসৎ মানুষের পাল্লায় পড়ে বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। যেন বাবার মুখে সোমা পড়তে পেরেছিল, এমন এক সমাজে আমরা আছি সোমা, যেখানে আমাকে চুরি করে তেলেভাজা খেতেই হয়। তুই আর কী করবি।
সোমা যেতে যেতে চারপাশে লক্ষ্য রাখছে। খুব ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। কলকাতায় জোরে সে কখনও গাড়ি চালাতে পারে না। পায়ে হেঁটে গেলে বুঝি আগে চলে যাওয়া যায়। ফলে যত মানুষ আছে তাদের মুখ দেখতে দেখতে যাচ্ছে। আবছা তাদের মুখ। আবছা বলেই সে যেন বুঝতে পারে—মানুষেরা কত উদ্বিগ্ন। ওর মায়া হয়।