ঘড়িতে ন’টা বাজল। সোমা ওপরে উঠে গেল। একগেলাস জল চেয়ে নিল। সে ট্যাবলেটটা ঘুমের বড়ির মতো মুখের ভিতরে ফেলে দিল। তারপর চারদিকে তাকাতেই মনে হল কফি হাউস ফাঁকা। কেউ আসেনি। এত বড় হলঘরটায় কেউ নেই। তাদের এবার কাজ আরম্ভ হবে। এক দুই করে এসে সবাই বসবে। ওরা সোমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এই সকালে এমন মেয়ে, মুখ—চেনা, একসময় এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মেরে গেছে। সুতরাং ওরা কেউ কাছে এসে দাঁড়াল। কী দেব?
সোমা বলল, আচ্ছা আবদুল, তোমার মনে আছে কাল ঐ কোণের টেবিলে পুল—ওভার গায়ে একজন বসেছিলেন? এই তোমার তখন সাতটা কী সাড়ে সাতটা হবে হয়তো।
আবদুল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। কত মানুষ আসে, সে কী করে জানব।
আচ্ছা ঐ কোণের টেবিলে কাল বিকেলে কে সার্ভ করেছিল বলতে পার?
আবদুল কাউন্টারে গিয়ে কী ফিসফিস করে বলল। ভিতরে তখন একটা কাচের গেলাস ভেঙে পড়ার শব্দ। ঝনঝন। বুকটা কেঁপে উঠল সোমার। সে বুঝি এল। তুমি জান সে লোকটাকে?
সে বলল, না দিদিমণি। আমি ঠিক খেয়াল করতে পারছি না।
কেন মনে নেই তোমার? সে পিছন ফিরে বসেছিল।
সে বলল, না। তারপর সে আর দাঁড়াল না। উত্তরের দিকে দুজন ভদ্রলোক এসে বসেছে। ওরা রোজই এ—সময় এখানে আসে। এক কাপ করে কফি এবং এক প্লেট স্যান্ডউইচ খেয়ে ওরা কোথায় একসঙ্গে কাজে যায়। ওদের কাছ থেকে এখন আর অর্ডার নেবার প্রয়োজন হয় না। এলেই কফি আর স্যান্ডউইচ দিয়ে আসে। ওটা ওর টেবিল বলে, সে চলে গেল।
সোমা এখন একা। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। সুভাষ বসুর ছবি। কিছুদিন আগে গান্ধী এবং নেহরুর দুটো ছবি ছিল। এখন আর সে ছবি দুটো নেই। নামিয়ে রাখা হয়েছে। অথবা চারপাশে যে সব তরুণেরা সমাজকে বদলে দেবার নেশাতে মেতে উঠেছে, তাদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য, নিরাপদ জায়গায় বোধহয় সরিয়ে রেখেছে।
ওর যে এখন কী করণীয়! সে বসে বসে এক কাপ কফি খেল। চোখে—মুখে ভীষণ দুশ্চিন্তার ছাপ যেন। এত বড় শহরে একজন অপরিচিত মানুষকে খুঁজছে। সে কোথায় পাবে তাকে। সে কাকে জিজ্ঞাসা করবে, করতে পারলে যদি কোথাও তার ঠিকানা মিলে যায়। ওর পাশাপাশি যেসব মুখ ছিল, সে যে কী বোকা, যদি একটা মুখ ভালো করে দেখে রাখত তবে আর একজন সাক্ষী থাকত তার, আচ্ছা আপনি বলতে পারেন, আপনার টেবিলে পিছন ফিরে যিনি বসেছিলেন তার নাম কী, কোথায় থাকেন?
সোমা কাউকে দেখেনি। একমাত্র চুরি করে টেবিলের সেই মানুষটিকে সে দেখেছে। ওর উচিত ছিল, টেবিলের সব মুখগুলো একবার ভালোভাবে দেখে রাখা। তবে সে অন্তত আজ অথবা কাল কাউকে কফি হাউসে পেয়ে যেত। পেয়ে গেলেই সে তার সন্ধান পেতে পারত। বোকার মতো তাকে এ—ভাবে বসে থাকতে হত না।
সুতরাং সে উঠে পড়ল। এই সকালে এখানে একা বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। বস্তুত সে যে কী চায়, তার কী পাওয়ার কথা ছিল, সে যেন নিজেও জানে না। কেবল সেই মানুষটির সঙ্গে দেখা হলেই যেন বলে দিতে পারত, তুমি সোমা এই চেয়েছিলে, এখন তুমি সব ভুলে গেছ। আর কী করা। সে ধীরে ধীরে নেমে গেল। তারপর বাড়ি। এবং দীর্ঘ সময় বসে থাকা। শুয়ে থাকা। এই যে দীর্ঘ সময় সে একা বাড়ি থাকবে তখন তার মনে হয় সব প্রাচুর্য অহেতুক মনীষ দুটো মানুষের জন্য আটকে রেখেছে। এত দরকার কী? সেই মানুষটাকে দেখার পর থেকেই এমন মনে হচ্ছে তার।
সোমা ভাবল, সে আবার বিকেলে আসবে ওকে খুঁজতে।
সে বিকেলে এসেছিল। রাতে চুপচাপ কোণের একটা টেবিলে বসেছিল। বিনুর সঙ্গে দেখা। বিনু অবাক। তুমি এখানে?
তোমাদের কাছে এলাম।
ওরে বাপস! কী বলছ!
আচ্ছা বিনু, কাল তুমি লক্ষ্য করেছিলে একজন যুবক হবে হ্যাঁ বেশ লম্বা—চওড়া মানুষ, সাদা পুল—ওভার গায়ে, কালো প্যান্ট পরনে ঐ কোণের টেবিলটায় বসেছিল, এবং আমাকে মাঝে মাঝে চুরি করে দেখছিল!
বিনু পাশে একটা চেয়ার টেনে আনতে আনতে বলল, আমি যেদিকে তাকিয়েছি দেখেছি সব চোখ তোমার দিকে। চুরি করে সবাই তোমাকে দেখছিল, এবং তোমার দেখা মানুষটি যে কে কী করে বলব!
সোমা কথা বলল না আর। বিনু বলল, কফি খেয়েছ?
আমি খাব না, তুমি খাও।
আমি মটন ওমলেট নিচ্ছি সঙ্গে।
নাও।
বিনু বলল, মনীষ এল না?
সোমা তাকাল বিনুর দিকে, সে এখানে আসে না বিনু।
কাল যে এল!
কাল এল, সেই ছবিটা দেখে ওর অতীত দিনের কথা মনে পড়ে গেছিল।
খুব আবেগের বশে এসে গেছে। আর আসবে না।
তুমি এলে?
আমি এসেছিলাম ওর সঙ্গে আমার দরকার ছিল।
কী দরকার?
কী যে দরকার আমি ঠিক জানি না। ওর সঙ্গে দেখা হলেই সে বলে দিতে পারত আমার কী দরকার।
তুমি নিজে তোমার দরকারের কথা জান না, তার সঙ্গে দেখা হলে তোমার কী দরকার সে বলে দিতে পারত—কেমন কথা?
ঠিক কথা বিনু। আমরা যে কী চাই নিজে বুঝে উঠতে পারি না। আর একজন মানুষের দরকার হয়, সে বলে দিতে পারে, তোমার এটা দরকার সোমা, তোমার ওটা দরকার নয়। অনর্থক তুমি ছুটে মরছ।
ওসব তত্ত্বকথায় আমি নেই সোমা। তাহলে আমি খাচ্ছি।
খাও।
বিনু বলল, তুমি এলে মাঝে মাঝে ভালো—মন্দ খাওয়া যায়।
তুমি আরও কিছু খাবে?
না, আর না। খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু পেটে সহ্য হয় না। পেটে বোধহয় আলসার হবে। মাঝে মাঝে ব্যথা হয়।
তবে এসব ছাইপাঁশ খাওয়া কেন?
খেতে খুব ভালো লাগে। আজ জান, আমাদের ওখানে আবার গণ্ডগোল। টু উইকেট ডাউন।