এমন কথায় সোমা সাড়া না দিয়ে পারেনি। চল। তারপরই আকাশের নক্ষত্র দেখা! সেই মানুষটাকে সারা বাড়িতে সে কোথাও আর দেখতে পেল না। রাত গভীর হয়ে গেছে। সবাই খেয়ে চলে গেছে। জলিকে নিয়ে সে কিছুক্ষণ মেতে ছিল। ওর বরকে নানারকম ঠাট্টা—রসিকতা করেছে। জলির বরটা যে কি! সে কথা বলতে পর্যন্ত পারে না যেন। ওর মনে হয়েছিল, মানুষটা দেখাচ্ছে এমন, যেন সে কিছু জানে না। তুমি যে সব জানো মশাই সে আমার জানতে বাকি নেই। আজ রাতে সবুর সইবে তো? এই জলি, আজ রাতে কিছু করেছিস তো খুব খারাপ হবে।
জলির বর এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন সে সোমাকেই খপ করে পাশে বসিয়ে ঠেলে ফেলে কী যে করে ফেলবে! সোমা চোখ দেখলেই মন দেখতে পায়। মানুষটা বড় বজ্জাত। সব জানে, অথচ নাবালকের মতো মুখ করে রেখেছে। এ মশাই, মুখ তুলুন। আপনাকে দেখে কে বর কে কনে বোঝা মুশকিল।
নানারকম সুবাস, এবং বাসর জেগে সোমার ক্লান্তি এসেছিল। ঘুম এসেছিল। সে উঠে বাইরে গেল। সমর গেল কোথায়? সমর ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে বলেছিল ঠাট্টা করে। সে কী সেখানেই আছে? সে কি কিছু খায়ও নি? ওর কেন জানি মনে হল ওকে খুঁজে দেখা উচিত। এ—বাড়িতে একমাত্র সমরই নিজের মানুষের মতো ব্যবহার করেছে। সবাই যখন কোনোরকমে জায়গা করে নিচ্ছে শোবার, যখন মাসিমা—মামিমারা ঘরে গোল হয়ে বসে আছে, জায়গা নেই বলে ঘুমাতে পারছে না, ওদের বিয়ের দিনের গল্প বলে হাসাহাসি করছে, তখন সোমা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙছিল। সে কোথায়? সমর, সে ধীরে ধীরে ডাকল, সমর তুমি আছ?
ছাদে উঠেই সোমা দেখেছিল সমর সেই একভাবে ছাদের কার্নিসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সোমা যে ডাকছিল, তা পর্যন্ত ওর খেয়াল নেই। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে আকাশ দেখছে। কী সুন্দর আকাশ, কত নক্ষত্র, নিচে দুই তরুণ—তরুণী। কাছাকাছি, অথচ ওরা কতদূরে। সোমা সমরের পাশে দাঁড়াল। কোনো কথা বলল না। নিচে বাসর। সবাই ঘুমিয়ে গেলে হয়তো মানুষটা জলিকে জিজ্ঞাসা করবে, তুমি আমার দিকে ও—ভাবে তাকালে কেন? জলি বলবে, কীভাবে?
সে বলবে, এই যে যেন আমি একটা চাষা মানুষ, তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি।
জোর করেই তো নিয়ে যাচ্ছ!
জোর করে না নিয়ে গেলে তোমাকে পেতাম কোথায়? বলে হয়তো জলির হাতটা দুহাতের ভিতর রেখে জলির শরীরের উষ্ণতা মাপছে এখন। জলি শিউরে উঠছে। ওর ভিতরটা কাঁপছে। মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তুমি আমাকে নাও। আর পারছি না। কতদিন এই এক অপেক্ষাতে ছিলাম।
সোমা ডাকল, সমর।
বল।
এ—ভাবে সারাক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে?
থাকতে ভালো লাগল সোমা।
খেলে না?
খেতে ইচ্ছে হল না।
না খেলে শরীর খারাপ করবে।
একদিন না খেলে কিছু হয় না।
কী দেখছিলে এতক্ষণ?
আকাশ দেখছিলাম।
আকাশে এত কী?
কী যে জানি না। সারা আকাশে সোমা বিশ্বাস কর তোমাকে দেখেছি।
আমাকে তোমার সত্যি ভালো লাগে?
সমর হাসল।
সোমা ওর আরও কাছে গেল। জান কী যে হল, বাসর জেগে আমারও ভালো লাগছিল না। কেবল তোমার কথা মনে হচ্ছিল।
সত্যি?
সত্যি।
আর কিছু লাগে না সোমা। আমার আর কিছু লাগে না। বলে সে কাছে এসেছিল। এবং ওর কপালে চুমু খেয়েছিল।
গালে খাও।
সমর ওর গালে চুমু খেয়েছিল।
ঠোঁটে।
সমর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল।
তারপর সমর সম্মতি পেয়ে আরও দূরে হাত দিতে চেয়েছিল। সোমা বলেছিল আজ আর না। প্রথম রাতে এর চেয়ে বেশি দিতে নেই।
সোমা পরদিন সকাল না হতেই বাড়ি ফিরে এসেছিল। সেই মধুর ঘটনার আর বাড়াবাড়ি সে চায়নি। তাকে কত বড় হতে হবে। তার সামনে কী সুন্দর ভবিষ্যৎ। আর এক জায়গায় আটকে থাকলে চলে না।
সোমা এবার গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল।
ছয়
সোমা গাড়ি থেকে নামল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হল দরজা বন্ধ কফি হাউসের। সে ঘড়ি দেখল। ন’টা বাজেনি। সে উত্তেজনার মাথায় খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। সে এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। পুরনো বইয়ের দোকানগুলোর দিকে সে এগিয়ে গেল। সে দুটো একটা বই হাতে নিয়ে দেখছে। পছন্দ হলে কিনে ফেলবে। অনেকদিনের অভ্যাস এটা। সে এখান থেকে বহু দুর্মূল্য বই কিনে নিয়ে গেছে একসময়। তার পড়ার বাতিকের চেয়ে সংগ্রহের বাতিক বেশি।
কিন্তু কী যে মনের ভিতর হচ্ছে। একটা দুটো বই দেখেই তার কেমন হাঁপ ধরে গেল। সে এবার গাড়িতে এসে বসল। মাথাটা ধরেছে মনে হয়। মাথা ধরা আজকাল নানা কারণে ঘটছে। সকালে কোনোদিন মাথা ধরেনি। আজ এই প্রথম। সে কফি হাউস খুললে, প্রথমেই এক গেলাস জল চেয়ে নেবে। এবং একটা অ্যাসপ্রো খেয়ে ফেলবে। সে ব্যাগে অ্যাসপ্রো খুঁজতে থাকল। কেন যে সকালে মাথা ধরা—বিকেলে হলে সে বুঝত যেমন ঘটে তাই ঘটছে। তারপরই মনে হল, সে এখানে কেন এসেছে? সেই মুখ এবং উদাসীনতা লক্ষ্য করবে বলে? মনে হয়! সে কি এখানে এখন আসবে? এলে সে বিকেলে আসতে পারে। নাও আসতে পারে। তাকে সে আবার দেখলে যেন ঠিক চিনে ফেলতে পারত। তাহলে মনের ভিতর যে কষ্টটা, ওকে কোথায় যেন দেখেছি, সে আমার মনের মানুষ যে রে, গানের কলির মতো একটা মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে ভেসে হারিয়ে যাচ্ছে।
যাক, তবে একটা অ্যাসপ্রা পাওয়া গেল। সে অ্যাসপ্রোটা হাতের দু আঙুলে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। নিরাময় হবে সে এবার। সংসারে মাঝে মাঝে এমন ট্যাবলেট খেলে মানুষ ভাবে নিরাময় হয়ে যাচ্ছে, বস্তুত কেউ নিরাময় হয় না। অসুখ তার ভেতরেই থাকে। সে তাকে নিয়ে শুধু বড় হয়।