এই রে খেয়েছে। এবারে আর রক্ষা নেই। ঠিক অরণ্যদেবের পাল্লায় পড়ে যাব। সোমার জন্য ঝড় জল, নদী সমুদ্র এবার সাঁতরে পার হয়ে যাবে মানুষটা।
সমর বলেছিল, তা তুমি ঠাট্টা করতে পার। তুমি কী তেল মাখো সোমা?
আমি তেলই মাখি না।
এমন সুন্দর চুল।
চুলে তেল মাখলে আজকাল চুল উঠে যায়।
কেন? কী কারণ?
তোমাকে আমাদের ফার্মে নিয়ে যেতে পারি। কী করে বাংলাদেশে টাকা তৈরি হচ্ছে দেখাতে পারি। ভেবেই তার মনে হল কী যে ভাবছে! সমরকে সে এখন পাবে কোথায়? তার ফার্ম তখন ছিল কোথায়? সে তো তখন বেঙ্গল কেমিক্যালের কী একটা তেল মাখত। এখন সে তেলের নাম মনে করতে পারছে না।
সোমা এবার চারপাশে লক্ষ্য রাখল। মাঝে মাঝে সে এ—ভাবে একা বের হয়। কলকাতার ফুটপাথে এবং গাছের নিচে অথবা গাড়ি বারান্দার নিচে অজস্র দুঃখী মানুষের ছবি দেখতে দেখতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। যেন বাংলাদেশের সব মানুষ চোখ বুজে আছে। এত বড় অসাম্য কারও চোখে পড়ছে না। সে মাঝে মাঝে কোনো যুবতী, হয়তো পাগল কিংবা অভাবে অনটনে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, ফুটপাথে দেখতে পায়। একা একা হেঁটে যাচ্ছে। গায়ে কোনো জামা—কাপড় নেই। অথবা কোনো কোনো রাতে সে বাড়ি ফেরার সময় দেখে ফুটপাথে উলঙ্গ মানুষ, অথবা এক বৃদ্ধ দীর্ঘদীন না খেতে পেয়ে মরে আছে। সে বাড়ি ফিরেই কেমন চুপচাপ বসে থাকে।
এ—সব দেখলেই সোমার মনে হয়, চুলে যে কোনো তেল মাখে না সেই মানুষটার মুখ উঁকি দেয় মনে! সে কে? সে কেন সহসা এসেছিল সেখানে? সে কেন তাকে এ—ভাবে টানছে? তার তো এখন কোনো অভাব নেই। সে বিরাট প্রাচুর্যের ভিতর দিনযাপন করছে। সময় কাটছে না বলে কোনো মিশনারি কলেজে অধ্যাপনা। গাড়িতে যায়, গাড়ি চালিয়ে নিজে ফিরে আসে। এই যে সে বলে এসেছে অফিসের আগেই সে বাড়ি ফিরবে, ফিরতে সে নাও পারে, তাতে মনীষের কোনো অসুবিধা হবে না, কারণ অফিসে তার কয়েকটা গাড়ি। নিজের নামে কোনো গাড়ি নেই। সে হাত ফাঁকা করে বসে রয়েছে। বড় চালাক মনীষ। এবং সেই মানুষের মুখ মনে পড়লেই সোমার কেন জানি মাঝে মাঝে মনীষকে বড় ধূর্ত মনে হয়।
কই, তুমি বললে না—তো সোমা, কী তেল মাখো?
কী তেল মাখি আমি জানি না সমর।
সে কী হয়! তুমি তেল মাখো তার নাম জানো না?
তুমি কী আমার মাথায় তেলের গন্ধ পাচ্ছ?
খুব সুন্দর তেলের গন্ধ।
ওটা তেলের গন্ধ নয় সমর। ওটা আমার শরীরের গন্ধ।
সমর বলল, সোমা, তোমার শরীরের এমন সুন্দর গন্ধ ভাবা যায় না।
কী করি বল। থাকলে তাকে তো ফেলে দিতে পারি না।
সমর ছাদে দাঁড়িয়ে আরও গল্প করতে চেয়েছিল। সোমার কেন জানি আর গল্প করতে ভালো লাগছিল না। নিচে মানুষজনের কোলাহল। কেউ কেউ উঠে দেখে গেছে সমর সোমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কী করছে। একবার সোমার মা সোমাকে ডেকেও গেছে। ও—ভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করলে চলবে? নিচে কত কাজ!
সমর বলেছিল, যাই মাসিমা।
সোমা বলেছিল, যাচ্ছি। তুমি কি এখন নামবে না সমর?
না। আমার এখানে কেন জানি আজ একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।
সোমা আর দেরি করেনি। সে নিচে নেমে গিয়েছিল। আয়নার ভিতর সে নিজেকে দেখেছিল। খুব সে তেমন সাজেনি। মুখে সামান্য পাউডার! এবং পোশাকে সে সবসময় সাধারণ। অথচ সে বুঝতে পারছে এই পোশাকই ওকে আজ এ—বাড়ির সবচেয়ে দামি এবং নামি মেয়ে করে রেখেছে। সে লক্ষ্য করেছে, সে একবার যেখানেই গেছে, মৃদুগুঞ্জন। মাইরি ভাই, আমি আর থাকতে পারছি না। কী রে, খপ করে ধরে ফেলব? আহা কী যে হেরিনু! সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে! আসলে কী যে অন্ধকার! আমি জানি না, আমার আজ কী হবে! কত রকমের সে কথা শুনতে পায়। আগে সে এ—সব কথায় মনে মনে রাগ করত, কিন্তু কেন জানি তার এ—সব দিনে দিনে গা—সওয়া হয়ে গেছে। এবং সে যত বড় হচ্ছে, মানুষেরা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকলে তার ভালো লাগে। সে ওদের কথায় রাগ করে না। মুচকি হাসে। এই হাসিটুকু কী যে রহস্যময়ী করে রাখে সোমা বুঝি জানত না। আর এই রহস্যময়তাই সোমাকে এত বেশি দামি করে রেখেছে। মনীষ কিছু বলতে পারে না। কিছু বললেই যেন সোমা তার ঘরে আর থাকবে না। সে সারা শৈশবে এবং সে যখন তরুণী ছিল, যে সব স্বপ্ন দেখত, সেই সব স্বপ্নের ভিতর ডুবে যাবে অথবা হারিয়ে যাবে।
সোমা সারাক্ষণ কাজ করেছিল তারপর। সে সমরের কথা ভুলে গিয়েছিল। সবাই ওকে ডেকে যেন কিছু বলতে চায়। কিছু যেন জিজ্ঞাসা করতে চায়। সে আর চারপাশে তাকাতেই পারে না। চোখ তুলে তাকালেই চোখে চোখ পড়ে যায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে তার ভারী লজ্জা লাগে।
সে চারপাশে তাকিয়ে কাজ করেনি বলেই জানে না সমর তখন কোথায়। যখন বরযাত্রীরা খেয়ে চলে গেল তখন ওর হুঁশ হয়েছিল সে অনেকক্ষণ সমরকে দেখছে না। এ—বাড়িতে একমাত্র সমরই সাহস করে ওর সঙ্গে আলাপ জমিয়েছে। আর যারা ওর মতো তরুণী অথবা যুবক পাশাপাশি, তারা কেউ আসেনি আলাপ করতে। পরিচয় করিয়ে দিলে কেমন নাবালকের মতো ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে। ভীতু কাপুরুষ মনে হয়েছিল সবাইকে। বরং সমরই বলেছিল, তোমার হাতে কী কাজ?
কিচ্ছু না।
চল ছাদে দাঁড়িয়ে একটু গল্প করি।
কী গল্প করবে?
যে গল্প করতে তুমি ভালোবাসবে।