এই সকালে কোথায় যাবে?
একটু গঙ্গার ধারে যাব।
মনীষ চাবিটা ছুঁড়ে দিল সোমাকে।—কখন ফিরবে?
তোমার অফিসের আগেই ফিরব।
সোমা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে দেখল চারপাশে শীতের রোদ। রাস্তায় এখনও ভিড় বাড়েনি। সে যে কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবল কাল সে যেখানে ওকে দেখেছিল, সেখানে যাবে। সে যদি আবার আসে।
সোমা খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। আঁচল পড়ে যাচ্ছিল, সে সেটা গুঁজে দিল। হালকা রোদের ভিতর নীল রঙের গাড়ি, সোমা লাল সিল্ক পরেছে। পায়ে আলতা। সে চোখে আজ কাজল দিয়েছে। এই প্রথম সে কাজল দিয়েছে। সেই কত কাল আগে কাকে যেন জীবন থেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল। সে বুঝি আবার ফিরে এসেছে। সে তাকে আজ খুঁজে বের করতে যাচ্ছে।
সোমার মাঝে মাঝে নানা দৃশ্য মনে আসে। মানুষটা কী অনিমাসির ভাশুরপো সমর? সমর কী এত সুন্দর ছিল? সে সমরকে বেশিদিন দেখেনি। মাত্র বিয়ের ক’দিন দেখেছে। সে নানাভাবে তাকে দেখল, সমর সুন্দর ছিল না। ভ্রূ সমরের এত টানা নয়। সে এ—ভাবে তাকাতে জানে না। সুতরাং সে কেন হবে। সে হলে ওর সঙ্গে উঠে দেখা করে যেত। এ—সুসময়ে আমাদের কথা তোমার মনে হয় তো? সে এ—সব জিজ্ঞাসা করত।
অনিমাসির মেয়ের বিয়ের দিনের কথা। জলি ওর বয়সি। অনিমাসি বারবার বলে গেছে, তুই যাবি সোমা। তুই না গেলে জলি খুব দুঃখ পাবে। সোমা তখন অনার্স নিয়ে পড়ছে। কোথাও কেউ যেতে বললে ওর বড় ভালো লাগে। সে যে সোমা দত্ত, তখন অবশ্য দত্ত ছিল না সে, গাঙ্গুলি, সে সুন্দর করে শাড়ি পরতে জানে, খোঁপা বাঁধতে পারে, চোখে কাজল না দিলেও মনে হয় কাজল দিয়েছে, আর তা ছাড়া প্রথম সে কলেজে ঢুকেছে, আবার তার অনার্স আছে, সে ভালো ছাত্রী, নাম—ডাক, সে যে কত ভালো এবং মেধাবী, কান পাতলে ফিসফিস কথায় সে যেন তা টের পায়।
সোমার মনে হত তখন সে আছে বলেই চারপাশে এত হাসি গান আনন্দ। সে ভালোভাবে তাকাতে পারে না চোখ চুলে। তাকালেই চোখে চোখ পড়ে যায়। সব যুবকেরা তার চারপাশে যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে। সে হাত তুলে দিলে সব সারি সারি যুবকের মিছিল, সামান্য তৃষ্ণার জল পান করবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
সে গিয়েছিল সকালে। তখন অনিমাসি ছাদের ঘরে ভাঁড়ার সামলাচ্ছে। বোধহয় সেটা ফাল্গুন মাস ছিল। ফাল্গুন মাসই হবে। কারণ তখন আকাশ বড় পরিষ্কার ছিল। খুবই পরিষ্কার। সে, সমর, এবং আরও চার—পাঁচজন যুবক ছাদে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে নক্ষত্র গুনত। কে ক’টা নক্ষত্র নির্ভুলভাবে গুনতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলত। সবাই পরস্পরের সততায় বিশ্বাস করত। সোমা বারবার গুনতে গিয়ে দেখছে সে ঠিকমতো গুনে যেতে পারে না। আকাশে এত নক্ষত্র, সে গুনবে কী করে! একদিক থেকে একটা দুটো পাঁচটা গুনলেই মনে হয় ভিতরে অজস্র নক্ষত্র রয়ে গেছে তার গোনা হয়নি। সে বলেছিল, না সমর, আমি গুনতে পারছি না।
সমর বলেছিল, যা, গুণতে পারবে না কেন? সবাই সব গুনতে পারে।
তুমি পার সমর?
পারি।
কত নক্ষত্র আকাশে বল?
দু হাজার তিনশো ছত্রিশ।
গুল।
গুল না সোমা। আমার আকাশে দু হাজার তিনশো ছত্রিশই আছে। যারা বাদ গেছে তারা আমার আকাশে নেই।
সোমা বলেছিল, তুমি বড় গুল মারতে পার সমর। আমার গুল মারতে ভালো লাগে না।
তুমি তবু গুল বলছ!
বলব না?
বলা উচিত না সোমা। কারণ—
কী কারণ? ছাদের ওপর সোমা আলগা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে আকাশ দেখছে। সমরের মুখ দেখে মনে হয়েছে সত্যি বুঝি আকাশের নক্ষত্র গোনা যায়। সে বলল, আমি যে পারছি না সমর। ক’টা গুনেই দেখছি তার চারপাশে অজস্র, আবার গুনতে গেলে দেখছি তার ভিতর আরও অজস্র। আমি গুনে শেষ করতে পারছি না, হাঁপিয়ে উঠছি।
বোকা। ও—ভাবে কী কেউ আকাশের তারা গুণে শেষ করতে পারে! বলে সমর ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি গুনছি তোমার হয়ে।
গোনো।
সে গুনতে থাকল। খুব সন্তর্পণে যেন সে গুনছে। একেবারে নিবিষ্ট মনে। আর যারা ছিল, তারা একে একে নেমে গেছে। আকাশে ওদের তারা গোনা বুঝি শেষ। কেবল বাকি সোমার। সোমারটা হয়ে গেলেই সমর নেমে যাবে।
সোমা নিশ্বাস বন্ধ করে প্রায় তাকিয়ে ছিল সমরের দিকে। সে গুনে কত নক্ষত্র বলবে সেই আশায়। নিশ্চয়ই বলবে সেই দু হাজার তিনশো ছত্রিশ। কিন্তু যখন বলল তখন দেখা গেল মাত্র একটা বলছে সমর, মাত্র একটা নক্ষত্র আকাশে!
কী বাজে বকছ?
হ্যাঁ ঠিক বলছি সোমা। তোমার আকাশে একটাই নক্ষত্র।
সোমা হেসে দিয়েছিল, বলেছিল, থাক মশাই, আপনাকে আর নক্ষত্র গুনতে হবে না। নিচে চলুন। বর এসে গেছে। এ—ভাবে দুজনকে ছাদে দেখে ফেললে নির্ঘাত প্রেম করছি ভাববে।
সমর এতবেশি স্মার্ট কথাবার্তা আশা করেনি। সে বলেছিল, তাহলে মেয়েরা প্রেম—ফেম করে আজকাল?
মেয়েরা করে না তো ছেলেরা করে?
কারা যে কী করে সোমা বুঝি না। তবে সত্যি বলতে কি, তোমাকে দেখলে প্রেম না করে পারা যায় না। কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
আর আমার তখন ইষ্টনাম জপতে ইচ্ছা হয়।
কিছু ইচ্ছা—টিচ্ছা হয় না সোমা?
হবে না কেন? সবই হয়।
আমারও যে কী ইচ্ছা হয়! হলে পরে ভালো লাগে না! একা দাঁড়িয়ে তখন নক্ষত্র গুনি। তবে কী জান, আমার আকাশে সব সময় সেই দু হাজার তিনশো ছত্রিশ। কেউ আমার দিকে তাকায় না। বড় কষ্ট হয় সোমা। সমর সত্যি কেমন বলতে বলতে সিরিয়াস হয়ে গেল।