সোমা বলল, তুমি সব ব্যাপারে নিজেকে টান কেন?
টানব না? তুমি এমন এক—একটা ব্যাপার করবে যে মনে হবে সব বুঝি গেল। আমার ভাবনার অন্ত থাকে না। কী করতে যে শখ করে পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম!
পুরোপুরি হয়ে গেলে তোমার এসব আর থাকবে না।
তার মানে?
মানে তখন দেখবে তোমার সময়ই হবে না বউ কোথায় থাকছে, কী করছে।
তোমাকে আজ জার্মানি, কাল আমেরিকা। বউ এদিকে পার্টি দিচ্ছে, পার্টি করছে। এখনও হওনি। চুনোপুঁটি হলেও না হয় কথা ছিল।
অসিত চাইছে না সোমার এসব উক্তি ওর সামনে হোক। কিন্তু সোমার দিকে তাকিয়ে বুঝল, সোমা আদৌই মাইন্ড করছে না। এ—সব কথা ঘরের সে তা আদৌই ভাবছে না। কোথায় যেন একটা অসীম দুঃখ আছে, সোমা তার বদলা সুদে—আসলে নিতে চায়। সেটা কি নিজের কাছে? সে কী বলছে, তুমি বড় ভুল করেছ সোমা, তুমি কিছু কিছু সৎ ব্যাপার এ—পৃথিবীতে আশা করেছিলে। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখছ আর্থিক অনটন তোমাদের সংসারকে কীভাবে তছনছ করে দিয়েছিল? তুমি বলেছিলে সবাইকে, তোমার বাবা মারা যাবার আগে কিছু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রেখে গেছেন। তোমার মা—ও তোমাকে এমন বলেছে। তুমিও সবাইকে এমন সব বলেছ। কিন্তু তুমি বড় হতে গিয়ে জানতে পারলে, এই অর্থ মা তোমার কীভাবে আনছেন। তোমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। মানুষের ওপর বিশ্বাস তোমার হারিয়ে গেল। তখন তুমি একজন মানুষকে মনে মনে খুঁজছিলে। সে থাকলে কিংবা তাকে পেলে তুমি হয়তো আর তোমার বিশ্বাসকে এমনভাবে বিসর্জন দিতে পারতে না। সমাজকে বদলে দেবার শপথ নিয়ে তুমিও হয়তো বের হয়ে পড়তে।
আচ্ছা, সোমা, তোমাকে একটা কথা বলি। তুমি কি ওকে সত্যি চিনতে পারনি?
না। চিনতে পারিনি। মিথ্যা বলে লাভ নেই।
মনীষের চিৎকার করে বলার ইচ্ছা—তোমার পূর্বপ্রণয়ী। আমি ঠিক জানি। তুমি আমার কাছে সব গোপন করছ।
সোমা মনীষের মুখ—চোখ দেখে বুঝতে পারল, মনীষ এ—ব্যাপারে সেন্টিমেন্টে ভুগছে। সে বলল, অসিতবাবু, মানুষটা কে আমার নিশ্চয়ই মনে পড়বে। আমি আজ তাকে আবিষ্কারের জন্য সারাদিন ভাবব। তবে দোহাই আপনাদের, আমার কোনো অসুখ আছে ভাববেন না। অসুখটা মনীষের। ওর টাকা করার বাতিক। একের পিছনে সে পর পর কেবল শূন্য বসিয়ে যেতে চায়। এটা মানুষের বড় রোগ। এ—রোগে পেলে মানুষ তার মায়া—মমতা হারিয়ে ফেলে। সমাজের যা কিছু সুন্দর সে হরণ করে নিতে চায়। চারপাশে এত কদর্য জীবনযাপন, সে চোখে কিছুতেই তখন তা দেখতে পায় না।
অসিত উঠে গেলে সোমা কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকল। তার কোনো কোলাহল যেন ভালো লাগছে না। এমনকি মনীষকেও তার ভালো লাগছে না। সে চোখ বুজে থাকলে টুকরো টুকরো ঘটনা মনে করতে পারে। একা ব্যালকনিতে পায়চারি করলে বাবার মুখ মনে করতে পারে। কী নিরীহ ছিল তার বাবা। সামান্য তার প্রত্যাশা। সে তার স্ত্রী এবং কন্যাকে সামান্য সুখে রাখার জন্য যৎকিঞ্চিৎ অর্থ এদিক—ওদিক থেকে রোজগারের চেষ্টা করত।
বাবা সামান্য কেরানি। জেলা অফিসে সে টেন্ডার ফাঁস করে কিছু অধিক রোজগার করত।
সোমা বাবার মুখ এ—সময় আর ভাবতে পারল না। কারণ বাবা তার কাছে সব সময়ই নিরীহ মানুষ। বাবার আত্মহত্যার পর এ—সব খবর যেন কানাঘুষা শুনেছে। তার এখনও বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সে জানে, সমাজে যারাই আছে, তারা এটা না করে বাঁচতে পারছে না। বাবাও পারেননি। সে তার বাবাকে এজন্য সব সময়ই ক্ষমা করে দেয়। তার বাবা মাঝে মাঝে তার জন্য তেলেভাজা কিনে আনত। বাবা এবং সে, মাকে গোপন করে কতদিন তেলেভাজা খেয়েছে। মা দেখলে বড় রাগ করত।
যেন চোখ বুজেই বলল, বাবা তুমি বড় বোকা। যে লোকটার হয়ে এসব করতে, সে কিন্তু বড় মান্য ব্যক্তি সমাজের। সে মাকে এখনও ভালো মাসোহারা দেয়। এটা ওর কী বদান্যতা! মাকে এত বলেও সোমা মাসোহারা নিতে বন্ধ করাতে পারেনি। মা—র এক কথা—এমন দুর্দিনে তিনি আমাদের দেখেছেন।
যত সে বড় হচ্ছে তত মনে হচ্ছে সংসারে তার মা—ও এক পাপে লিপ্ত। সে জানে না, কী যে যথার্থ কারণ। প্রথম যেদিন সে জেনেছিল, বাবার ব্যাঙ্কে কোনো ব্যালেন্সই নেই, বাবা সব তেলেভাজা খেয়ে উড়িয়ে গেছেন, এবং এই টাকা এক মহামান্য ব্যক্তির, তখন সোমার কী যে ঘৃণা হয়েছিল মায়ের ওপর! কিন্তু মা—র চোখমুখ দেখে সে কিছু বলতে পারেনি! মা—র মুখে বড় বিষণ্ণতা ছিল সেদিন। কার জন্য আমি এটা করেছি সোমা? তোর জন্য। আমার আর কী আছে! তোর বাবার বড় ইচ্ছা ছিল তুই বড় হবি। লেখাপড়া শিখবি। তোর বাবা বি.এ. পাস ছিল না। তুই বি.এ. পাস করবি। তোর বাবা থাকলে আজ কী যে তিনি সুখী হতেন।
সোমার ভাবলে অবাক লাগে তার বাবা টিপিক্যাল ছাপোষা মানুষ ছিলেন।
সোমা এখন উঠবে ভাবল। রসুলকে গাড়ি বের করতে বলল। সে অযথা ঘুরবে আজ। সে মনীষকে বলল, আমি একটু বের হচ্ছি মনীষ।
মনীষ তার ঘরে বসে কিছু ফাইলপত্র দেখছিল। আর একটু বেলা বাড়লেই অফিসের বড়বাবু এসে মনীষকে কী বোঝাবে। তখন সোমার সারা বাড়িটার ওপর রাগ হয়। সংসারে একমাত্র মানুষটার টাকা বাদে অন্য চিন্তা নেই। সে সেই বড়বাবুকে দেখলেই বলবে, আপনাদের কী বাজার—টাজার করতে হয় না? সকালে এসে সারাক্ষণ কী যে এত আপনাদের কাজ। বলার পরই মনে হয় সে মনীষের বউ। মনীষ এ—ব্যাপারে রাগ করতে পারে। তার অযথা কথা বলা উচিত হচ্ছে না। সে একেবারে চুপ করে যায়।