মনীষ বলল, দ্যাখো সোমা, ছেলেবেলায় আমরা অনেক কিছু ভাবি। ছেলেরা সবাই বিদ্যাসাগর হতে চায়। আর মেয়েরা ভগবতী দেবী। কিন্তু কী জান, যত বড় হই তত দেখি এমন সমাজ—জীবনে আমরা বড় হয়ে উঠেছি, যেখানে কেউ আর ইচ্ছে করলেই সেটা হতে পারে না! বলে সে প্রায় ব্যাখ্যা করার মতো বলল, এই যে ধর যদি আমি চাইতাম বিদ্যাসাগর হব, কিংবা তোমার কোনো পরিচিত বন্ধু বিনুর কথাই ধর, সে তো কম সৎ ছেলে নয়, আমি ওকে জানি, কিন্তু বেচারা কী করবে, টাকার জন্য বস্তাপচা নোট লিখছে এখন। সে জানে এতে প্রকৃত শিক্ষা হয় না, কিন্তু ওর এতবড় সংসারে কে সাহায্য করবে? ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালে তোমরা ওকে আর চিনতেই পারবে না। আমাদের সবারই এখন ভয়—কাল ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াব। ন্যায় অন্যায় বুঝছি না, যা পারছি সংগ্রহ করে ব্যাঙ্কে জমা রাখছি।
সোমা খুব মন দিয়ে শুনল। তুমি আজকাল ভালো কথাও শিখে গেছ মনীষ! একেবারে নেতাগোছের মানুষের মতো একটা বক্তৃতা করে ফেললে।
বক্তৃতা নয়। তোমাকে তো আমি জানি। তোমাকে আমি এ—সব কথা ক্লাস করার ফাঁকে ফাঁকেও বলতে শুনেছি। ফুটপাথে অথবা কোনো গ্রামে—গঞ্জে মানুষের অপমান দেখলেই তুমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে, বলতে এসব আর দেখা যায় না চোখে। সব ভেঙে ফেলা দরকার।
অসিত এসেছে ডাক্তারি করতে। এখন সে বুঝতে পারছে না কে রোগী। মনীষ না সোমা। সোমার মুখ হাসিতে সব সময় সপ্রতিভ। সে এতটুকু রাগছে না। মনীষ কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। এবারে অসিত নিজেই সোমার মুখে গোটা ঘটনাটা জানতে চাইল—কাল কী হয়েছে আপনাদের!
কিছুই হয়নি। কেবল আমি ভাবছিলাম ওকে আমি কোথায় দেখেছি।
মনে করতে পারছেন না?
না।
তার জন্য ভাবনার কী আছে।
আমি তো তাই বলছি ওকে।
সময় সময় মানুষের এটা হয়। খুব একটা প্রিয় ঘটনা, যা জীবনে সবচেয়ে মনে বেশি থাকার কথা, সেই ঘটনার নায়ক সামনে হাজির হলে, সাময়িক স্মৃতিবিভ্রম হয়। পরে সেটা আস্তে আস্তে কেটে যায় এবং যখন সব মনে পড়বে, তখন অদ্ভুত হাসি পাবে। আরে, এমন ঘটনা জীবনে ঘটেছে তা বেমালুম ভুলে গেছি। বলে সে সোমার দিকে তাকাল। এ নিয়ে বেশি ভাববেন না।
আমি আদৌ ভাবছি না। যে ভাবছে তাকে বলুন।
মনীষ কেমন হতাশার চোখে দেখল সোমাকে। এই যুবতীকে সে এত ভালোবাসে! ওর এতটুকু কিছু হলে ওর ঘুম আসে না। আর কাল সোমা যা দেখে রাতে ঘুমোল না ভাবলে ভিতরটা আগুন হয়ে যাচ্ছে। সে আধুনিক ছেলে। সে মেয়েদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবু এমন একজন রূপবান ছেলেকে সে চিনতে পারছে না, সে যে বলতে পারছে না, এই মুহূর্তে তার বিশ্বাস করতে কেন জানি কষ্ট হচ্ছে। সোমা ইচ্ছা করেই সব গোপন রাখছে। সে যখন এমন সুন্দরী, তখন তার কৈশোরে কেউ পাশাপাশি হেঁটে আসেনি, কেবল সে—ই ওকে ধরে নিয়ে এসেছে অথবা জয় করেছে —ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল।
সে বলল, সোমা আমার ঘাট হয়েছে। কিন্তু অসিত তুই জানিস, সকালে বের হয়ে দেখি শীতের বারান্দায় একটা সামান্য র্যাপার জড়িয়ে বসে রয়েছে। ডাকছি হুঁশ নেই।
সোমা বলল, ওটা কিছু না। তুমি তো জানো মনীষ, বাবা আমাদের জন্য তেমন কিছু রেখে যাননি। মা খুব অনটনের ভিতর আমাকে সেই টাকাতেই মানুষ করেছেন। আমি সুন্দরী ছিলাম। কী অসিতবাবু এ—ব্যাপারে আপনার কী মত?
আপনি এখনও দেবীর মতো।
তা হলে বুঝতে পারছ মনীষ, দূরের পথ হাঁটতে গেলে কিছু হোঁচট খেতেই হয়। আর রূপবতী হলে তো কথাই নেই।
এখানেই অসিতের একটু গোলমাল ঠেকল। তৃতীয় ব্যক্তির সামনে সোমা কেমন বেআব্রু হয়ে যাচ্ছে। সে অন্যদিকে কথা টানার জন্য বলল, দেখলে তো মনীষ, বাংলাকে সন্তোষ ট্রফি থেকে কেমন জোর করে হারিয়ে দিল।
মনীষের এ—সব শুনতে ভালো লাগছে না। সে শুধু বলল, অসিত, তুই আয়।
অসিত বলল, তা হলে আসি।
সোমা বলল, কফি হচ্ছে।
আর একদিন হলে হয় না?
যা দিনকাল পড়ছে, আর একদিন যে আসতেই পারবেন ঠিক কি?
মনীষ কিছু বলছে না। নিজের এই আহাম্মুকির জন্য কেমন সে এবার নিজের ওপরই ক্ষেপে গেল। বলল, তোরা বোস, আমি আসছি।
তুমি গেলে চলবে কী করে? তুমি বোস।
মনীষ সোমাকে কেন যে চটাতে ভয় পায়। সে বসে পড়ল।
আজকাল এটা ওর হয়েছে অসিতবাবু। খুব সহজে চটে যায়। ভেঙে পড়ে। কিছুই ধৈর্য ধরে শুনতে চায় না।
অসিত বলল, দেশের যা অবস্থা, খুব ধৈর্য ধরে না শুনলে যে চলবে না।
মনীষ বলল, তাই বলে কি মানুষ দিনদুপুরে হত্যা করবে? বিচার থাকবে না? অসিত বলল, আজকাল বুঝি এসব খুনোখুনির ব্যাপার আপনাদের খুব হন্ট করছে? বলে সে সোমার দিকে তাকাল।
আমাকে করছে না।
কেন করছে না? মনীষ এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রক্তমাংসের শরীর হলে না করে পারে?
কী করব! বল তোমাকে এ—ব্যাপারে অনেক কথা বলতে পারি। তবে বলব না। অসিতবাবু এসেছেন, বলা ঠিক হবে না।
সোমা আর কোনো কথা বলতে চাইল না। সে কফির পট থেকে লিকার ঢেলে অসিতের দিকে তাকাল। বলল, পাতলা না ঘন? দুধ কম বেশি। চিনি দেব, না দেব না?
অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন এখন অসিত। সে বলল, আমি আজকাল সবরকমের খেতে অভ্যস্ত। যা দেবেন। তারপর সে মনীষের দিকে তাকিয়ে বলল, গিন্নি কি তার লেফট—মাইন্ডেড?
কী জানি ভাই, কী মাইন্ডেড সে—ই জানে। নারী—চরিত্র দেবতারা শুনেছি বুঝতে পারে না। আর শালা আমি তো মনুষ্য—জাতির অযোগ্য। হবু ক্যাপিটালিস্ট।