সোমা ওর খাটের পাশে চুপচাপ বসে থাকল। শুল না।
তুমি মনে করতে পারলে?
না।
কোথায় দেখেছ মনে করতে পারছ না?
না পারছি না। আমি যে কী করি! কিন্তু জান, খুব চেনা। এবং কতকালের চেনা মনে হচ্ছে।
তুমি যে বলতে ছেলেবেলা তোমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিল, তার মা—মরা ছেলে তোমাদের বাড়ি থেকেই মানুষ?
অমলের কথা বলছ?
হ্যাঁ, অমল।
ওকে দেখলে আমি চিনব না! সে কি বসে থাকার ছেলে! দিদি বলে ছুটে আসত না!
তুমি অযথা ভাবছ। হয়তো চেনাই নয়। তুমি সুন্দর বলে চোখ ফেরাতে পারেনি। পালিয়ে পালিয়ে তোমাকে দেখছিল।
তা এ—ভাবে দেখে?
তোমার মন বড় দুর্বল। সে হয়তো এমনি দেখছিল, এখন তুমি তার নানারকম অর্থ খুঁজছ।
হবে। সে এ নিয়ে আর তর্ক করতে চাইল না। না, ঘুমোনো যাক, বলে সে এক পাশে আলগা হয়ে শুল।
কাছে এসে শোও না, যেন পরপুরুষের কাছে রাত কাটাতে এসেছ।
সোমা বলল, বেশ আছি মনীষ। আমাকে আর টানাটানি কোরো না। আমাকে ঘুমতে দাও।
সে এবার ঘুম যাবার জন্য চোখ বুজল। এবার সে ঘুমোবে। অযথা সে আর আজে বাজে চিন্তা মনে টেনে আনবে না।
চার
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল, সোমা বিছানাতে নেই। সোমার ঘুম থেকে বেলায় ওঠার স্বভাব। মনীষ ঘুম থেকে উঠে একবার চা খেয়ে নেয়। তখনও সোমা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। ওর সুন্দর পা বিছানার ওপর খালি। গাউন ওপরে উঠে থাকে। এ—ঘরে কেউ আসবার যেহেতু নিয়ম নেই, মনীষ ইচ্ছা করেই গাউন টেনে নামিয়ে দেয় না। সে ধীরে ধীরে চায়ের কাপ নিয়ে এ—ঘরে ঢুকে যায়, চা খায়। এবং পায়চারি করতে করতে সোমার অস্বাভাবিক সুন্দর সুঠাম শরীর দেখতে দেখতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আজ সে দেখল বিছানা খালি। এত তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়ায়, বাথরুমে গেছে সে এমন ভাবল। সে ডাকল, সোমা আছ? কোনো সাড়া সে পাচ্ছে না।
সে বাইরে এসে দেখল সোমা একটা ইজিচেয়ারে মোটা একটা র্যাপার জড়িয়ে বসে আছে। সব শরীর ঢাকা। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। হলুদ রঙের স্কার্ফ। করুণ শীতার্ত চোখ—মুখ তার। মনীষকে দেখেও সে এতটুকু নড়ে বসল না। প্রায় স্থির পাথরের মূর্তির মতো। যেন কেউ এই সকালে বারান্দার দেয়ালে সুন্দর এই শীতার্ত ছবি এঁকে দিয়ে গেছে। চোখের নিচে ঘুম না যাবার চিহ্ন। ক্লান্ত চোখ—মুখ। সে বলল, তোমার ঠান্ডা লাগবে সোমা।
সোমা কেমন ওম শব্দ করে ফের নিরুত্তর থাকল। মনীষ কেন যে ভীষণ ক্ষেপে গেল, সে বলে উঠল, কী বলছি শুনতে পাচ্ছ? বলছি ভিতরে যাও। ঠান্ডা লাগিয়ে অসুখ বাধাবে।
যেন দেয়ালের ছবি মুহূর্তে জ্ঞান পেয়ে ওর দিকে চোখ তুলে তাকাল। কী বলছে শোনার চেষ্টা করল, তারপর ফের ঘুম গেল দেয়ালে। সোমা চোখ নামিয়ে নিল।
মনীষ বুঝল এবার ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার। এভাবে ব্যাপারটাকে চাপা দিলে চলবে না। সে ফোন করল, অসিত আছিস?
কে?
আমি মনীষ।
মনীষ দত্ত? কী ভাগ্য! সহসা গরিবের এত্তালা?
শোন, তুই সকালে ফ্রি আছিস?
কেন, কী হয়েছে?
আছিস কিনা বল?
নেই। তবে তুমি বললে করে নিতে হবে।
একটু আমার বাড়িতে আসবি? সোমাকে একটু দেখবি?
কী হয়েছে ওর?
ফোনে সব বলা যাবে না। এলে জানতে পারবি।
সোমা কান খাড়া করে শুনছিল। মনীষ ওকে জোর করে কিছু করতে চায়। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। মনীষ ডাক্তার ডাকছে। আমার কিছু হয়নি মনীষকে এমন বলতে চাইল। কিন্তু বললে কে শুনছে? সে রাতে ঘুমোতে পারেনি। সে এখানে এসে এই শীতের রাতে কেমন কষ্ট অনুভব করতে চেয়েছে। যেন এই যে চারপাশে এত দীন দুঃখী মানুষ সারারাত ফুটপাথে কাটায়, এই যে গ্রামে মাঠে মানুষ অন্নহীন বস্ত্রহীন দুঃখী, সে দুঃখী মানুষের মতো থাকতে চায়। সে তার মুখ দেখার পর চোখ দেখার পর এমন করতে ভালোবাসে।
আর আশ্চর্য, অসিত এলে সোমা তাকেই বলল, আসুন। কী ব্যাপার, এদিকে পথ ভুল করে?
মনীষ এমন স্বাভাবিক চেহারা সোমার আশাই করতে পারেনি। শুধু চোখে—মুখে রাতের না ঘুমোনোর কষ্টকর ছবি। সে সিনেমাতে যে সোমাকে নিয়ে গিয়েছিল এ ঠিক সেই সোমা।
সোমা অনুযোগ করল, আজকাল আর এদিকে একেবারেই আসেন না।
অসিতের চোখ ট্যারচা হয়ে গেল। তবু সে ডাক্তার। অনেক সময় রুগির স্বাভাবিক কাজকর্মের ভিতরই অনিয়ম থাকে, শৃঙ্খলা থাকে না। আপাত মনে হবে সবই ঠিক, অথচ একটু খুঁটিয়ে দেখলে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, না, গোলমাল আছে। সে বসল।
সোমা বলল, কফি না চা? হট না কোল্ড? কী চাই?
অসিত বলল, হট।
সোমা বলল, আজকাল হটই পছন্দ সবার। যা দিনকাল পড়েছে।
অসিত বলল, আজ আমাদের হাসপাতালে চারজন এসেছে।
সবাই বেঁচে আছে তো?
একজন বাদে সবাই টেঁসে গেছে।
কীরকম বয়স?
এই পনেরো থেকে কুড়ি!
আহা রে! কার মার সন্তান!
অসিত সোমার মুখ দেখল। সোমা উঠে গেলে মনীষকে বলল, কিরে, বাপ হবার চেষ্টা করছিস না?
করছি তো। কিন্তু কিছুতেই পা মাড়াচ্ছে না। সব অনিয়ম হতে পারে, কিন্তু ট্যাবলেটটি খেতে ভুলবে না।
আমার তো কিছু খারাপ লাগছে না, কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
মনীষ গত রাতের ঘটনা সোমার অজ্ঞাতে বললে অসিতকে কেমন চিন্তিত দেখাল।
সোমা এসে দেখল দুই বন্ধু মুখ ভার করে বসে আছে। সোমা বুঝতে পারল মনীষ সব বলেছে। সে হেসে দিল ওদের মুখ দেখে।—কী হল আপনাদের? চুপচাপ?
অসিত তাকাল সোমার দিকে। সোমা আবার হেসে দিল। আপনারা ভাবছেন কী জানি কী হয়ে গেল। কিচ্ছু হয়নি। কাল কফি হাউসে আমার খুব পরিচিত একজন মানুষকে দেখলাম। অথচ চিনতে পারলাম না। এখনও মনে করতে পারছি না। কেবল এটুকু মনে পড়ছে আমি যা হতে চেয়েছিলাম পারিনি।