অজয় প্রায় নীচে নামিয়া আসিয়াছিল, এক ধাপ উঠিয়া কহিল, “আমি বহু পুণ্যাত্মার অভিসম্পাত কুড়িয়েই জীবনে যাত্রা করেছি,প্রদীপ। কোনো পরিণামই আমার পক্ষে অপ্রত্যাশিত হবে না। কিন্তু সবাই যদি সৰ্বান্তঃকরণে নমিতাকে শাপ’, তা হলেই তার কল্যাণ হবে। জান, আমি ক্ষণকালের জন্য তার চোখে বিদ্যুৎ দেখেছিলুম। অভি সম্পাতে সে-আগুন হয় ত’ আরেকবার জ্বলে উঠবে—আরেকবার।”
অজয়কে আর দেখা গেল না।
১৫. নমিতা এক-এক রাজ্যের লজ্জা লইয়া
নমিতা এক-এক রাজ্যের লজ্জা লইয়া পুনরায় শ্বশুরালয়ে ফিরিয়া আসিল। গত্যন্তর ছিল না। গিরিশ বাবু এ-হেন কুস্বভাবা মেয়ের দায়িত্ব লইবেন কোন সাহসে? তাই একদিন অবনী বাবুকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা উল্লেখ না করিয়া তিনি মোটামুটি বুঝাইয়া দিলেন যে মেয়েটার সত্যকার পুণ্য-সঞ্চয় হইবে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করিয়াই; তাহার সংসার শ্বশুরবাড়ির উঠোনটুকুতেই। শেষকালে এইটুকুও টীকা দিলেন: মেয়ে বড় হইয়াছে, তাহার কাৰ্যকলাপ শাসনের চক্ষে অনুধাবন করিতে হইবে। কথাগুলি নমিতার সামনেই বলা হইয়াছিল; কিন্তু এত লজ্জাকর উপদেশ শুনিয়াও কেন যে তাহার মরিতে ইচ্ছা করিল না সে নিজেই বুঝিতে পারে নাই।
অবনী বাবু নমিতাকে লইয়া আসিলেন। একখানি ছোট ঘর ছাড়া তাহার জন্য সামান্য একটু বারান্দাও আর রহিল না। সেই ঘরেরই বাহিরে অপরিসর একটু জায়গায় একটা ভোলা-উনুনে তাহাকে রাধিতে হয়। সমস্ত সংসারযাত্রা হইতে বিচ্ছিন্ন নির্বাসিত নমিতা আর কি করিবে? বড় ঘর হইতে স্বামীর বৃহদায়তন ফোটোটা পাড়িয়া আনিয়া দুই বেলা তাহারই ধ্যান করে। স্বামীর মুখ সে প্রায় ভুলিয়া গেছে; মনে করাইয়া দিবার জন্য একটা প্রতীকের আবশ্যক আছে বৈকি। এক-এক সময় তাহার মনে হয় এ মুখ যেন অন্য কারুর, তাহার স্বামী এই ছবির চেয়েও জীবন্ত ও সুন্দর ছিল। কিন্তু মনে-মনে স্বামী-ধ্যান করিলে তাহার খ্যাতি বাড়িবে না বলিয়াই এমন একটা সর্বজনগ্রাহ লৌকিক উদাহরণকে সে প্রতিষ্ঠিত করিতে চায়।
আর কোনো কাজে সে মন বসাইতে দেয় না। অজয়ের দেওয়া বইগুলি সে কোথায় ফেলিয়া আসিত? কিন্তু উহাদের একটিররা পৃষ্ঠা উলটাইলে তাহার স্বামী-পূজার ব্যাঘাত হইবে বলিয়া সে উহাদের স্পর্শ পৰ্য্যন্ত করে না। মালী দরজার গোড়ায় ফুল রাখিয়া যায়, তাড়াতাড়ি স্নান সারিয়া সে সেই ফুল লইয়া খেলিতে বসে। পিঠের উপর ভিজা চুলগুলি বিপর্যস্ত হইয়া লুষ্ঠিত হয়, সিক্ত শীতল শরীর হইতে এমন একটি সুন্দর পবিত্রতা বিচ্ছুরিত হইতে থাকে যে নমিতার পর্যন্ত নিজের জন্য মায়া করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে সেই নির্জীব অন্ধ ও বধির ছবির সম্মুখে নিজের এই পরিপূর্ণ দেহ-পাত্রখানি আত্ম-নিবেদনের অর্ঘ্যস্বরূপ তুলিয়া ধরে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটে, দেবতা আসিয়া তাহাকে স্পর্শ করে না, না বা সম্ভাষণ! কে সেই দেবতা? চক্ষু বুজিয়া ভাবিতে ভাবিতে ভুল হইয়া যায়, স্বামীর স্মৃত মুখকে উজ্জ্বল করিবার জন্য তাকায়, কিন্তু কৃত্রিম ছবি সাহায্য করিতে পারে না। কোথা হইতে আরেকখানি মুখ অন্ধকার অন্তরে আসিয়া অনধিকার প্রবেশ করে। শত মনঃসংযোগ করিয়াও সে-মুখ নমিতা তাড়াইতে পারে না। তার দুই চোখে কি দুনিবার তেজ, ললাটে কি অহঙ্কার—কখনো কখনো ফুল নিবার জন্য সে এমন উৎসাহে হাত বাড়াইয়া দেয় যে ফুল তাহাকে দিতেই হয়। সেই দুরন্ত দেবতাকে প্রত্যাখ্যান করিবার উপায় কৈ? সেই দেবতা নমিতাকে ঘর ছাড়িবার জন্য একদিন শঙ্খ বাজাইয়াছিল। দেবতাকে সে ফিরাইয়া দিয়াছে, কিন্তু তাহার শঙ্খধ্বনি কবে হইতে আর শোনা যাইবে না?
মনের এই চাঞ্চল্য দমন করিতে হইবে। সংসার বলে, বিধবার পক্ষে এই চিত্তবিভ্রম পাপ—তথাস্তু, সংসারের আদেশ শিরোধার্য। নমিতা কৃচ্ছসাধনায় মন দিল। একবেলা আহার করিত, এখন আহারের সংখ্যাগুলি এত কমাইয়া ফেলিল যে অরুণা পৰ্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। পুত্রবধুর এই স্বামীচৰ্যা তাহার খুব ভালো লাগিয়াছিল, কিন্তু এত বাড়াবাড়ি তাহার পছন্দ হইল না। তিনি বাধা দিতে চাহিলেন, কিন্তু নমিতা তাহাতে কান পাতিবে কোন লজ্জায়? সে নিরঙ্কু একাদশী করে, ব্ৰত-উপবাস তাহার লাগিয়াই আছে। গুরুঠাকুর মন্ত্র দিতে চাহিলে সে পরিষ্কার কণ্ঠে বলে : স্বামীর নামই আমার জপমন্ত্র। আপনারা যদি এক টুকৃররা পাথরে ভগবান পান, একটা ছবিতে তাকে পাওয়ায় আমার হানি কি? আমি স্বামী বুঝি, নারায়ণ বুঝি না।
সমস্ত সংসার নমিতার প্রশংসায় মুখর হইয়া উঠিল। সে তাহার কলঙ্কিত আচরণের প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছে! সমস্ত সাহসিক ক্রিয়ার বিরুদ্ধে এমনই একটি প্রতিক্রিয়া না পাইলে সংসার তাহার সামঞ্জস্য হারায়। সেই শান্তি ও সামঞ্জস্য রাখিতে নমিতা এমন করিয়া তাহার স্বভাবের প্রতিকূলতা করিতেছিল। কিন্তু ক্রমে-ক্রমে এই কৃত্রিম পূজায় তাহার নেশা লাগিয়া গেল। খুনী সাধু ছদ্মবেশে আত্মরক্ষা করিতে গিয়া সাধু বনিয়াছিল, বহুলাচরিত অভ্যাসে নমিতাও যে তপশ্চারিণী হইয়া উঠিবে তাহাতে বিচিত্রতা কোথায়? কিন্তু স্বামীকে মূর্তি দিতে গেলেই তাহার সমস্ত গোলমাল হইয়া যায়, তখন নিজেকে বৈধব্যচারিণী বঞ্চিতা বলিতে তাহার মন উঠে না। সংসারে তাহার এই আচরণটাই শোভন ও বাঞ্ছনীয়—এই ভাবিয়াই সে রোজ স্নান করিয়া চন্দন ঘষে, ফুল দিয়া ফোটা সাজায়, ভুলিয়াও একবার জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়ায় না। সে এত করে, তবু তাহার মন ভরিয়া উঠে না কেন? না; মানুষের মন একটা ব্যাধি; পায়ের তলায় বিধিয়া-থাকা কাটার মত তাহাকে উপড়াইয়া ফেলিতে হইবে। মনের টু টি টিপিয়া ধরিবার জন্য নমিতা গীতার একটা বাক্ক-সংস্করণ খুলিয়া বসিল।