কয়েক ধাপ নীচে নামিয়া অজয় নমিতার প্রায় নিকটে আসিয়া কহিল,—“বাড়িটা কঁকা-ফঁকা ঠেছে। দিদি ওঁরা কোথায় গেলেন?”
এ-প্রশ্নটা এমন নয় যে ইহার উত্তরে বাক্যস্ফুরণ করিলে নমিতার অঙ্গহানি হইবে, যদিও কড়া শাসনের অত্যাচারে তাহার আত্মকর্তৃত্বহীনা অবামুখী হইয়া থাকিবারই কথা ছিল। কিন্তু উত্তরটা এত সহজ ও সময়টি এত নিভৃত যে, নমিতা চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। স্পষ্ট করিয়াই কহিল,—“কাকিমারা সবাই ম্যাটিনিতে থিয়েটার দেখতে গেছেন।”
—“ছেলেপিলেরাও গেছে?”
–“হ্যাঁ।“
—“সুমি গেল না কেন?”
একটু থামিয়া নমিতা বলিল,-“মা যেতে দিলেন না।”
এই থামিবার অর্থ টুকু অজয় বুঝিল। সাহস করিয়া কহিল,-“কিন্তু তুমিও বাড়িতে রইলে যে। গেলেই ত’ পারতে।”
দৃঢ়নিবদ্ধ ঠোঁট দুইটি ঈষৎ প্রসারিত করিয়া নমিতা আবার একটু হাসিল! কিছু বলিবার আর প্রয়োজন ছিল না। এই হাসিটিতে বিষাদের স্বাদ পাইয়া অজয় বলিল,—“তোমার বুঝি আনন্দ করবার অধিকার নেই?”
নমিতার মুখ সহসা গম্ভীর হইয়া উঠিল, অজয় সিড়ির যেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, নামিতে হইলে তাহার স্পর্শ হইতে আত্মরক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে; তাই সচকিত হইয়া নমিতা কহিল,—“সরুন।”
—“নীচে কেন যাচ্ছ?”
—“মা-র আহ্নিকের জন্যে গঙ্গাজল আতে।”
-“তুমি আহ্নিক কর না?”
অজয় ভাবিয়াছিল ইহার উত্তরে নমিতার মুখে আবার হাসি ফুটিবে। কিন্তু নমিতা সত্যভাষণের উপযুক্ত সহজ ও স্পষ্টস্বরে বলিল,—“পূজোর পরে আমাদের গুরুদেব আসবেন—তার কাছ থেকে আমার মন্ত্র নেবার কথা আছে।”
কথাটা শুনিয়া অজয়ের সমস্তগা যেন জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু চিত্তের অসন্তোষ দমন করিয়া সংযত শান্তকণ্ঠে কহিল,—“এই অল্প বয়সেই স্বর্গের জন্যে তোমার এত লোভ?”
উদাসীনকণ্ঠে নমিতা উত্তর দিল : “এ-ছাড়া আমার আর কী-ই বা করবার আছে?” বলিয়া সিড়ি দিয়া একটু তাড়াতাড়িই নীচে নামিয়া গেল।
ঘটে করিয়া গঙ্গাজল লইয়া উপরে উঠিবার সময় নমিতা দেখিতে পাইল অজয় তেমনি সিড়ির উপর দাঁড়াইয়া আছে—যেন তাহারই প্রতীক্ষায়। সঙ্কুচিত হইয়া স্পর্শ বাচাইয়া আবার সে উঠিতে যাইতেছে, অজয় বলিল,-“তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে—অনেক কথা। তোমার সঙ্গে এতদিন এক বাড়িতে বাস করে’ও যে আলাপ হয় নি, তার কারণ আমার সৌজন্যের আতিশয্য আর তোমার ভীরুতা। কিম্বা সত্য কথা বলতে গেলে আমাদের সমাজের অনুশাসন। আজ যখন দৈবক্রমে তোমার সঙ্গে আলাপ হ’লই, তখন একটু সবিস্তারে তোমার সঙ্গে কথা ববার অনুমতি আমাকে দেবে না?”
কি বলিবে নমিতা কিছু ভাবিয়া পাইল না; যেন তাহার গ্রীবা সম্মতিসূচকসঙ্কেত করিয়া বসিল।
উপরে উঠিবার পথ ছাড়িয়া দিয়া অজয় আবার কহিল,—“অনুমতি ত’ তুমি দেবে, কিন্তু তোমার অভিভাবকরা যে তাতে আলাদে আটখানা হবেন তার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এতদিন একসঙ্গে থেকে আমি এটুকু যে একেবারেই বুঝিনি তা তুমি মনে কোরো না। আচ্ছা, সে-কথা পরে হবে—মাকে গঙ্গাজল দিয়ে এস। আজকে বিকেলে অন্তত অভিভাবকদের শুভেচ্ছা তোমাকে স্পর্শ কবে না।”
বলিয়া অজয় চলিয়া যাইতেছিল, নমিতা সোৎসাহে প্রশ্ন করিল, “কোথায় যাচ্ছেন?”
—“এই আসছি—আমার ঘরের জালাগুলো ভোলা আছে, কী রকম মেঘ করেছে দেখেছ? একবার বৃষ্টি নামলে আর রক্ষে নেই— বিছানা-বালিশ সব কাদা! অভিজ্ঞতাটা অবশ্যি নতুন হতো না, কিন্তু কাল থেকে জ্বর-ভাব হয়েছে বলে একটু সাবধান হচ্ছি। আমি যাচ্ছি ওপরে-বারান্দায়। দু’ মিনিট।”
বারান্দা বলিতে ঐ দক্ষিণের বারান্দাটিই বুঝায়,—মাকে আহ্নিকে বসাইয়া, দুয়েকটি গৃহকৰ্ম্ম সারিয়া নমিতা ধীরে বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার আগেই অজয় রেলিঙ ধরিয়া দাঁড়াইয়া রাস্তার দিকে চাহিয়া আছে। প্রথম অজয় নমিতার আবির্ভাবটিকে লক্ষ্য করিল না বলিয়া, আর দুয়েক পা অগ্রসর হইয়া আরো একটু কাছে আসিতে নমিতার ভারি লজ্জা করিতেছিল, কিন্তু আরো একটু কাছে না আসলে আলাপ অন্তরঙ্গ হইয়া উঠিতে পারে না। নুমিতা কি করিবে কিছু ভাবিয়া না পাইয়া তেমনি রেলিঙ ধরিয়া দূরে কালো আকাশের পানে তাকাইয়া রহিল।
অজয়ই হঠাৎ সজাগ হইয়া কাছে সরিয়া আসিল। কোনো রকম ভূমিকার সূচনা না করিয়া সোজাসুজি প্রশ্ন করিল : “পূজো-আহ্নিক করা ছাড়া তোমার আর কোনো বড় কাজ করবার সত্যিই কি কিছু নেই?”
নমিতা কথা বলিতে জোর পাইল না বটে, কিন্তু তবু কহিল, “ওঁদের মতে পূজো-আহ্নিক করে বাকি জীবনটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেওয়াই আমার লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
—“বাকি জীবন?” অজয় যেন আকাশ হইতে পড়িল : “বাকি জীবন সম্বন্ধে তুমি কিছু স্পষ্ট ধারণা করতে পারো? তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে এই ছোট সঙ্কীর্ণ আকাশটুকু দেখে সমস্ত পৃথিবীর ছবিটা মনে মনে একে নিতে পারো? বাকি জীবন! অসৌজন্য মাপ করো, তোমার বয়েস কত?”
নমিতা লজ্জায় মুখ নামাইল। অজয় আবার কহিল,-“তোমার মতো বয়সে ফ্রান্সে জোয়ান অব আর্ক দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছিলো—বাকি জীবনটাকে খরচের ঘরে ফেলে দেউলে হয় নি। সেসব খবর তুমি নিশ্চয়ই রাখে না, তাই এমন স্বচ্ছন্দে নিজের সম্বন্ধে এতটা উদাসীন হ’তে পেরেছ। তোমাকে তিরস্কার করছি না, কিন্তু এটা মনুষত্ব নয়।”
নমিতার স্বর ফুটিতেছিল না, তবু প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া কহিল,–কিন্তু বিধবার আর অপর কর্তব্য নেই। ভগবৎ-ভক্তিই তার একমাত্র ভরসা।”