হাসির প্রাণবন্ত প্রস্রবণ এই শিবরাম। সব চেয়ে সুন্দর, সবাইকে যখন সে হাসায় তখন সেই সঙ্গে সঙ্গে নিজেও সে হাসে এবং সবাই চেয়ে বেশি হাসে। আর, হাসলে তাকে অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। গালে কমনীয় টোল পড়ে কিনা জানি না, কিন্তু তার মন যে কী অগাধ নির্মল, তার পরিচ্ছন্ন ছায়া তার মুখের উপর ভেসে ওঠে। পরকে নিয়ে হয়ত হাসছে তবু সর্বক্ষণ সেই পরের উপর তার পরম মমতা! শিবরামের কোনো দল নেই ও নেই। তার হাসির হাওয়া জন্যে প্রত্যেকের হৃদয়ে উন্মুক্ত নিমন্ত্রণ। শিবরামই বোধ হয় একমাত্র লোক যে লেখক হয়েও অন্যের লেখার অবিমিশ্র প্রশংসা করতে পারে। আর সে-প্রশংসায় এতটুকু ফাঁক বা ফাঁকি রাখে না। আজকালকার দিনে লেখক, লেখক হিসেবে যত না হোক, সমালোচক হিসেবে বেশি বুদ্ধিমান। তাই অন্য লেখককে পরিপূর্ণ প্রশংসা করতে তার মন ছোট হয়ে আসে। হয়ত ভাবে, অন্যকে প্রশংসা। করলে নিজেই ছোট হয়ে গেলাম। আর যদি বা প্রশংসা করতে হয় এমন কটা কিন্তু আর যদি এনে ঢোকাতে হবে যাতে বোঝা যাবে লেখক হিসাবে তুমি বড় হলেও বোদ্ধা হিসেবে আমি আরো বড়। মানে প্রশংসা করতে হলে শেষ পর্যন্ত আমিই যেন জিতি, পাঠকেরা আমাকেই যেন প্রশংসা করে। বুদ্ধির সঙ্গে এমন সংকীর্ণ আপোষ নেই শিবরামের। যদি কোনো লেখা তার মনে ধরে সে মন মাতিয়ে প্রশংসা করবে। আর প্রশংসা করবে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, নিজের জন্যে এতটুকু সুখ-সুবিধে না রেখে। এই প্রশংসায় তার নিজের বাজার উঠে গেল কিনা তার দিকে না তাকিয়ে। যতদূর দেখেছি, শিবরামই তাদের মধ্যে এক নম্বর, যারা লেখক হয়েও অন্য লোকের লেখা পড়ে, ঠিকঠাক মনে রাখে ও গায়ে পড়ে ভালো লেখার সুখ্যাতি করে বেঁড়ায়।
কিন্তু এক বিষয়ে সে নিদারুণ গভীর। অন্তত সে-সব দিনে থাকত। হাইকোর্টের আদিম বিভাগে কি এক মহাকায় মোকদ্দমা হচ্ছে তার ফলাফল নিয়ে। অবিশ্যি অফল নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই, কেননা অফলে যেমনটি আছে তেমনটিই থাকবে-মুক্তারামবাবুর ব্রিটে মেসে সেই তারামে শোওয়া আর কারাম ভক্ষণ—এ তার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু ফল হলেই বিপদ। তখন নাকি অর্ধেক বা আর সেই সঙ্গে আস্ত একটি অর্ধাঙ্গিনী জুটে যাবার ভয়। মোমায় যে ফল হয় নি তা শিবরামকে দেখলেই বোঝা যায়। কেননা এখনো সে ঐ একই, আছে, দেড় হয়নি; আর মুক্তির আরামে আছেও সেই মুক্তারামবাবুর মেসে। সারা জীবনে যে একবারও বাসা বদল করে না সে নিঃসন্দেহ খাঁটি লোক।
মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে, আর শিবরামের মুখে চলেছে শব্দের খেলা। কুমার হয়তো একটা ভুল পাশ দিলে, অমনি বলে উঠল। কুমার; কিংবা গোষ্ঠর সঙ্গে প্রবল ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ল বিপদের খেলোয়াড়, অমনি বলে উঠল : এ বাবা, শুধু গোষ্ঠ নয়—গোন্ত। মাঠের বাইরেও এমনি খেলা চালাত অবিরাম। জুৎসই একটা নাম পেলেই হল—শত্রু-মিত্র আসে যায় না কিছু। নিজের নামের মধ্যে কি মজার pun রয়েছে শুধু সেই সম্বন্ধেই উদাসীন।
আরেক আবিষ্কার আমাদের বিশুদা-বিশ্বপতি চৌধুরী। একখানা বই লিখে যে বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। ঘরের ডাক-এর কথা বলছি—খেলার মাঠেও তার সেই ঘরের ডাক, হৃদয়ের ডাক। সহজেই আমাদের দলের মধ্যে এসে দাঁড়াত আর হাসাত অসম্ভব উচ্চ গ্রামে। হাত অথচ নিজে এতটুকু হাসত না-মুখ-চোখ নিদারুণ নিলিপ্ত ও গভীর করে রাখত। সমস্ত হাসির মধ্যে বিস্তার সেই গাভীটাই সব চেয়ে বেশি হাস্যোদ্দীপক। শিবরাম শুধু বক্তা, কিন্তু বিশুদা অভিনেতা। শিবরামের গল্প বাস্তব কি বিশুদার গল্প একদম বানানো। অথচ, এ যে বানানো তা তার চেহারা দেখে কারু সন্দেহ করার সাধ্য নেই। বরং মনে হবে, এ যেন সদ্য-সদ্য ঘটেছে আর বিশুদা স্বয়ং প্রত্যক্ষদর্শী। এমন নিষ্ঠুর ও নিখুত তার গাম্ভীর্য। উদ্দাম কল্পনার এমন মৌলিক গল্প রচনার মধ্যেও বাহাদুরি আছে। আর সব চেযে কেরামতি হচ্ছে, সে-গল্প বলতে গিয়ে নিজে এতটুকু না-হাসা। মনে হয়, এ যেন মোহনবাগান গোল দেবার পর গো–ল না বলা। শুনলে হয়তো সবাই আশ্চর্য হবে, মোহনবাগান গোল দেয়ার পরেও বিশুদা গম্ভীর থেকেছে।
তার গাম্ভীর্যটাই কত বড় হাসির ব্যাপার, একদিনের একটা ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে। খেলার শেষে মাঠ পেরিয়ে বাড়ি ফিরছি, সঙ্গে বিশুদা। সেদিন মোহনবাগান হেরে গেছে যেন কার সঙ্গে, সকলের মন-মেজাজ অত্যন্ত কুৎসিত। বিশুদা যেমন-কে-তেমন গম্ভীর। কতদূর এগোতেই সামনে দেখি কতকগুলো ছোকরা দুই দলে ভিন্ন হয়ে গিয়ে একে-অন্যকে নৃশংসভাবে গালাগাল করছে। আর এমন সে গালাগাল যে কালাকাল মানছে না। তার মানে, একাল নিয়ে তত নয়, যত পূর্বপুরুষদের কাল নিয়ে তাদের মতান্তর। প্রথম দলের দিকে এগিয়ে গেল বিশুদা। স্বাভাবিক শান্ত গলায় বললে, কি বাবা, গালাগাল দিচ্ছ কেন? বলেই বলা-কওয়া নেই কতকগুলি চান্ত গালাগাল বিশুদা তাদের লক্ষ্য করে ছুড়ে মারল। তারা একদম ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল—কে এই লোক! পরমুহূর্তেই অপর দলকে লক্ষ্য করে বিশুদা বললে, সব ভদ্রলোকের ছেলে তোমরা, গালাগাল করবে কেন? বলেই ওদেবর দিকে কতকগুলো গালাগাল ঝাড়লে। প্রথম দল তেড়ে এল বিশুদার দিকে : আপনি কে মশাই আমাদের গালাগাল দেন? দ্বিতীয় দলও মারমুখো। আপনি গালাগাল করবার কে? আপনাকে কি আমরা চিনি, না, দেখেছি? দেখতে দেখতে দু দল একত্র হয়ে বিশুদাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হল। বিশুদার গম্ভীর মুখে দুষ্টু একটু হাসি। করজোড় করে বললে, বাবারা, আর কেন? যে ভাবেই হোত, দু দলকে মিলিয়ে দিয়েছি তোত। যাও বাবার বাড়ি যাও। এমনি একত্র হয়ে থাক—মাঠের খেলায় দেশের খেলায় সব খেলায় জিততে পারবে। আমার শুধু মিলিয়ে দেওয়া কথা। নইলে, আমি কেউ না।