বিরাজ ভুরু কুঁচকে বলেছিল, সুবোধ-প্ৰবোধের সঙ্গে আর মিল কই?
সুবৰ্ণ হেসে কুটি কুটি হয়েছিল, কেন, অবোধ-নির্বোধ!
সঙ্গে সঙ্গে ঠিকরে উঠেছিল বিরাজ, বয়সের থেকে অনেকখানি জোরালো ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল, এত আস্পদ তোমার মেজ বৌ? সেজদা ছোড়দাকে তুমি নির্বুদ্ধি বলতে সাহস পাও? রোসো, মাকে বলে দিয়ে আসছি!
মাকে বলে দেওয়ার নামে অবশ্য সুবর্ণর মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত হয়ে ওর হাত চেপে বলেছিল, ওমা, তুমি রাগ করছ, কেন, ভাই? আমি তো ঠাট্টা করেছি—
কিন্তু বিরাজ হাত ধরার মান রাখে নি, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মুক্তকেশীর আবির্ভাব।
চেঁচানো না, ধমকানো না, থমথমে গলায় বললেন, কোন লক্ষ্মীছাড়া ঘরে মানুষ হয়েছিলে মেজবৌমা, শিক্ষা-সহবৎ নেই? এদিকে পাকা পাকা কথার জাহাজ? বলি পোবা-পেকার নাম নিয়ে ধিক হয়েছে কেন শুনি?
সুবৰ্ণ এবার সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলে, আমি তো ঠাট্টা করেছি।
ঠাট্টা? ঠাট্টা করেছ? বলি মেজবৌমা, ঠাট্টাটা কাকে করেছ? এই শাশুড়ীমাংগীকে, আর সেই মরা শ্বশুরকে তো? নামকরণ তো। ওরা নিজেরাই করতে যায় নি, এই আমরাই করেছি। সাতজন্মে এমন কথা শুনি নি যে, পুটকে একটা বৌ এসে ঠিকুজি-কুলুজি চাইতে বসে, নাম নিয়ে ব্যাখ্যানা করে। এ্যা, পোবা-পেকা শুনলে কী বলবে গো!
সুবৰ্ণতা বলে ফেলে, সবাইকে যদি শুনিয়ে বেড়ান, তবে আর কি করবো? আমি তো কাউকে শোনাতে যাই নি। ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ছোট-ঠাকুরঝি লাগিয়ে দিতে গেল কেন?
বৌয়ের মুখ থেকে এমন স্পষ্ট পরিষ্কার ভাষা শোনার অভ্যাস মুক্তকেশীর নেই। বড় বৌ উমাশশীর মুখ দিয়ে সাত চড়ে রা বেরোয় না। বোনপো-বৌ ভাগ্নে-বৌ তা-ও অনেক দেখেছেন, পেটে পেটে বজাতি, হাড়-হারামজাদা হলেও মুখে এমন খই ফোঁটায় না কেউ।
আরো থমথমে গলায় বলেন, আমার গর্ভের মেয়ের আমন লাগানো-ভাঙানো স্বভাব নয় মেজবৌমা। ভাইদের ঘেন্না দেওয়া দেখে প্ৰাণে বড় লেগেছে। তাই বলে ফেলেছে। তোমার চরণেই কোটি কোটি নমস্কার মা। নামের আবার মানে চাই! বাপের কালে শুনি নি এমন কথা। জানতাম না। তো ঘরে আমার এমন বিদ্যোবতী বৌ আসবে, তা হলে মানে খুঁজে খুঁজে নাম রাখতাম। আচ্ছা! আসুক আজ পেভা, সে তো দুটো পাস করে তিনটে পাসের পড়া ধরছে, শুনছি। নাকি ওকালতি পড়বে। তাকেই জিজ্ঞেস করবো কোন নামের কি মানে? আর বলবো, এত বিদ্যে করেও তোদের
সুবৰ্ণ অভিমানী, কিন্তু সুবৰ্ণ কথায় খই ফোঁটায়, আত্মস্থ থাকতে পারে না। রাগ হলে চাপাবার ক্ষমতা নেই সুবর্ণর। তাই সুবৰ্ণ ফের শাশুড়ীর মুখের উপর বলে বসে, আপনারা বড্ড তিলকে তাল করেন, তুচ্ছ কথা নিয়ে এত হৈ-চৈ করতে ভাল লাগে।
মুক্তকেশী বসে পড়েন।
মুক্তকেশী বলেন, রাজু, এক ঘটি জল আন, মাথায় থাবড়াই। সই-মা আমার কত জন্মের শক্ৰ ছিল গো, এই মেয়ে গছিয়েছে আমায়া!
বিরাজ ছুটে জলের ঘটি নিয়ে আসে, মুক্তকেশী খাবলে খাবলে খানিক মাথায় থাবড়ে বলেন, এ বৌ নিয়ে ঘর করা হবে না। আমার, দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। সেই ভবিষ্যৎ। রাজু দোরটা দে, আমি একবার বাদুড়বাগান ঘুরে আসি। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল।
মাথার মধ্যে আগুন যখন-তখনই জ্বলে ওঠে মুক্তকেশীর। একটা মাত্র ছেলেকে স্বামী দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, আর তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এই পর্যন্ত। বাকী তিন-তিনটে ছেলেকে টেনে তুলতে হয়েছে, শেষ মেয়েটা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠল।
এখন তবু দুই ছেলে রোজগার করছে, বড়র মাইনেও বেড়েছে। তখন যে টানাটানিতে চলেছে, ঈশ্বর জানেন আর মুক্তকেশী জানেন। সেই সব কষ্টই আগুনের উপাদান হয়ে মজুত আছে ভিতরে। একটু-ওদিকেই জ্বলে ওঠে সেই আগুন।
কিন্তু ঘরসংসারে তো এতদিন এদিক-ওদিক ছিল না। যা কিছু বাইরে। ঘরে ছেলেরা জোড়হস্ত, বড় বৌ তো মাটির ঘট, মেজ বৌ এসে ঢোকা পর্যন্ত থেকে থেকেই আগুন জ্বলে। আর উঠতে বসতে সেই পরলোকগতা। সইমার উদ্দেশ্যে অভিযোগবাণী বর্ষণ করেন।
তাও কি পার আছে?
মুখরা মেজ বৌ। কিনা বলে বসে, মরা মানুষটাকে আর কত গাল দেবেন? সেখানে বসে জিভ কামড়ে কামড়ে নতুন করে মরবো যে! একে তো আমি পৌত্রী হয়ে রাতদিন শাপ দিচ্ছি—
তুমি শাপ দিচ্ছ! মুক্তকেশী হঠাৎ থতিয়ে গিয়েছিলেন, ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, তুমি শাপ দিচ্ছ কোন দুঃখে?।,
যে দুঃখে আপনি দিচ্ছেন সেই দুঃখে, সুবৰ্ণ আকাশপানে তাকিয়ে উদাস গলায় বলেছিল, আর এখন দোষ দিই না, অদেষ্ট বলে মেনে নিয়েছি।
সুবৰ্ণর এই সব কথা শুধু মেয়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, পুরুষদের কানেও ওঠে। মুক্তকেশীই ওঠান, রোজ একবার করে হাতজোড় করে সংসার থেকে ছুটি চান।
শুনে মুক্তকেশীর বড় ছেলে মাঝে মাঝেই বলে, তোমরাই বা মেজ বৌমাকে অত ঘাটাও কেন বুঝি না। বুঝতেই তো পারো, একটু তেজী প্রকৃতির আছেন উনি—
কিন্তু মেজ-সেজ ছোট এই মারে তো এই কাটে করে ওঠে। বয়সে বড় দেবীরদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা কওয়া চলে না, তাই দেবীররা একতরফা গর্জন করে, মাকে অপমান? ভেবেছেন কি মেজ বৌ? মেজদার যাই রাজা দশরথের অবস্থা তাই পার হয়ে যাচ্ছেন, আর কেউ হলে আমন পরিবারের মুখ জুতিয়ে ছিঁড়ে দিত। তেজী প্রকৃতি আছেন উনি বলে তো দাদা তুমি দিব্যি আস্কারা দিলে, বলি মার অপমানটা গায়ে বাজল না তোমার!
সুবোধ সহাস্যে বলে, আহা, এক ফোঁটা মেয়ের কথায় মার আবার অপমান কিসের? গ্ৰাহ্য করেন কেন?