বিয়ে হলে এসে মায়ের জন্যে কি কম গঞ্জনা সইতে হয়েছে সুবৰ্ণকে? তখন মানে বুঝতো না সব কথার, এখন তো বোঝে! বোঝে তো কী কলঙ্কের ডালি মাথায় নিয়ে সুবর্ণর জীবন শুরু!
সুবৰ্ণর সামনেই তো গিন্নীরা বলাবলি করেছে, হ্যাঁগা ঘরণী গিন্নী, সংসারী বিয়ের যুগ্যি দুদুটো ব্যাটা, আমন শিবতুল্য স্বামী, আর মাগী কি না কুলে কালি দিয়ে চলে গেল!
বেয়ানের দোষ ঢাকতে যত না হোক, নিজের বংশের মান সামলাতেই তাড়াতাড়ি বলতেন, কুলে কালি অবিশ্যি নয়, তবে স্বামী-পুতুরের মুখে চুনকালি দিয়ে তো বটেই। মেয়েকে ইস্কুলে দিয়ে হাতী করবেন, এই বাসনায় ছাই পড়লো, শাশুড়ী বেগতিক দেখে নাতনীটাকে নিজের কাছে আনিয়ে নিয়ে ঝটপট বে দিয়ে ফেলল, এই রাগে গরগরিয়ে মানুষ ঠিকরে চলে গেলেন কাশীবাস করতে!
কাশীবাস! হুঁ! এই বয়সে কাশীবাস!
মহিলারা নাক সিটকোন। অর্থাৎ পুরোপুরি অগ্রাহ্যই করেন কথাটা। এতক্ষণ যে সুবর্ণর মার বিয়োসের ব্যাখ্যায় তৎপর হচ্ছিলেন, তা মনে রাখেন না।
মুক্তকেশী। আবার সামলান।
বলেন, কাশীতে যে বাপ বুড়ো আছেন গো মাগীর!
থাকুক। ঝঙ্কার দিয়েছেন তারা, বলি স্বামী-পরিত্যাগিনী তো বটে! সে মেয়েমানুষের আর রইল কি? তুমি ভাই মহৎ, তাই আবার ওই বৌকে ঘরে তুলেছি, কোন না হাতেও জল খাবে।
মুক্তকেশী সদৰ্পে ঘোষণা করেছেন, জলি? জল আমি কোনো বেটির হাতেই খাই না। আপন পেটের মেয়েদের হাতেই খাই নাকি? যেদিন থেকে হাত শুধু করেছি, একবেলা স্বপাক হবিষ্যি, আর একবেলা কাঁচা দুধ গঙ্গাজল, ব্যস!
গরবিনী মুক্তকেশী অতঃপর আপনি কৃন্ত্রসাধনের ব্যাখ্যা করতে বসতেন, সুবর্ণ হাঁ করে শুনতো। হ্যাঁ করেই, কারণ তখন তো জানতো না সুবৰ্ণ, আচমনী খাদ্য মানে কি, অম্বুবাচী কাকে বলে, নিরন্তু উপোসের দিন বছরে ক’টা?
দীর্ঘশ্বাস-মর্মরিত ঘর ক্রমশ স্থির হয়ে আসে, সারাদিনের পরিশ্রান্ত মেয়েটার চোখে ঘুম আসে নেমে, সঙ্কুচিত হয়ে ঘুমন্ত মানুষটার ছোঁওয়া বাঁচিয়ে শুয়ে পড়ে সে। লোকটার ওই পরিতৃপ্ত ঘুমন্ত দেহটার দিকে তাকিয়ে কেমন ঘৃণা আসে, অপবিত্র লাগে লোকটাকে।
এই কিছুক্ষণ আগেই যে ওর আদরের দাপটে হিমশিম খেতে হয়েছে, তা ভেবে বুকটা কেমন করে ওঠে।
কিন্তু কী করবে সুবৰ্ণ?
চারিদিকে কত লোক, বিদ্রোহ করে কি লোক-জানাজানি কেলেঙ্কারি করবে? তা ছাড়া সব দিনগুলোই তো আজকের মত নয়? সব দিনেই কিছু আর বিদ্রোহ আসে না। নিজের মধ্যেও কি নেই ভালবাসার আর ভালবাসা পাবার বাসনা?
কী করবে। তবে সে? ওকে ছাড়া আর কাকে? আর ওই মানুষটা ভালবাসার একটাই অর্থ জানে, আদর করবার একটাই পদ্ধতি।
নেব না বললে দাঁড়াবে কোথায় সুবৰ্ণ?
১.০৩ মুক্তকেশীর চার ছেলে
মুক্তকেশীর চার ছেলে।
সুবোধ, প্ৰবোধ, প্রভাস, প্রকাশ।
বড় সুবোধ বাপ থাকতেই মানুষ হয়ে গিয়েছিল, বাপাই নিজের অফিসে ঢুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন, কালক্রমে সেই মাৰ্চেণ্ট অফিসের বড়বাবুর পরবর্তী আসনটিতে এসে পৌচেছে সুবোধ, প্রকৃতপক্ষে তার টাকাতেই সংসার চলে।
মেজ প্ৰবোধ এনট্রান্স পাস করে অনেকদিন খেয়ে খেলিয়ে বেড়িয়ে এই কিছুদিন হল এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা ফেঁদেছে। টাকাটা বন্ধুর, খাটুনিটা প্ৰবোধের। সেজ প্রভাস হচ্ছে বাড়ির মধ্যে সেরা বিদ্বান ছেলে, এফ-এ পাস করে ফেলে সে ওকালতি পড়বে পড়বে করছে। আর প্রকাশ গোটা পাঁচ-ছয় ক্লাস পর্যন্ত পড়েই পাড়ার শখের থিয়েটারে স্ত্রীভূমিকা অভিনয় করছে আর চুলের কেয়ারি করছে। সুবর্ণর বিয়ের সময় সংসারের অবস্থা প্ৰায় এই ছিল।
অনেকদিন পর্যন্ত সুবর্ণ এদের সকলের পুরো নাম জানত না। সুবো, পেবো, পেভা, পেকা এই ছিল মুক্তকেশীর সম্বোধনের ভাষা। ছোট ননদ বিরাজকে ডেকে একদিন ধরে বসলো সুবর্ণ, তোমাদের সব নাম কি বল তো শুনি! মা তো তোমায় রাজু রাজু করেন, রাজবালা বুঝি?
শোনো কথা! রাজু অবাক হয়ে বলে, এতদিন বে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ির লোকের নাম জানো না? মেজদা বলে নি?
সত্যি বলতে, রাজুর মেজদাকে কোনোদিন এ কথা জিজ্ঞেসও করে নি। সুবর্ণ। মনেও পড়ে নি জিজ্ঞেস করতে। এখনই হঠাৎ মনে পড়লো, জিজ্ঞেস করে বসলো। কিন্তু সেকথা না ভেঙে সুবর্ণ ঠোঁট উল্টে বলে, তোমার মেজদাকে জিজ্ঞেস করতে আমার দায় পড়েছে। তুমি রয়েছে হাতের কাছে, অন্যের খোশমোদ করতে যাবো কেন?
বয়সে তিন বছরের ছোট ননদিকেও এই তোয়াজটুকু করে নেয়। সুবৰ্ণ।
রাজু অবশ্য তাতে প্রীতিই হয়। আঙুল গুনে বলে, বড়দির নাম হচ্ছে সুশীলা, মেজদির নাম সুবলা, সেজদি হচ্ছে সুরাজ, আমি বিরাজ, আর দাদাদের নাম হচ্ছে–
মহোৎসাহেই গল্প হচ্ছিল ননদ-ভাজে। হঠাৎ সমস্ত পরিস্থিতিটাই গেল বদলে। বিরাজ রেগে ঠরঠরিয়ে উঠে গেল সেখান থেকে এবং তৎক্ষণাৎ মেজ বৌয়ের দুঃসাহসিক স্পর্ধার কথা সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল।
ভাসুর-দেওরদের নাম নিয়ে তামাশা করেছে সুবর্ণ, ননদের নাম নিয়ে ভোঙিয়েছে!
করেছে। সত্যই করেছে সেটা সুবর্ণ।
কিন্তু সুবর্ণ কি জানতো একটু কৌতুকে এত দোষ ঘটবে? আর নামের মানে জিজ্ঞেস করলে অপমান করা হয়?
সুরাজ শুনে বলে উঠেছিল সে, ওমা, সুরাজ আবার কি রকম নাম? ও নামের মানে কি?
একে যদি ভেঙানো বলে তো ভেঙানো।
তবে হ্যাঁ, দেওরদের সম্পর্কে বলেছে বটে একটা কথা তামাশা করে। পর পর চারজনের নাম শুনে হি হি করে হেসে বলে উঠেছে, তা চার ভাইয়েরই মিল করে নাম রাখলে হতো!