বাড়ির বড় মেয়ে, জামাই দ্বিতীয় পক্ষের হলেও একটা কেষ্টবিষ্ট, কেউ তাই আর তাকে দাবড়াতে পারে নি, কিন্তু বৌকে কচি বাচ্ছা বলায় হেসেছিল সবাই। বলেছিল, আসছে জন্মে আবার ন বছরের হবে ও মেয়ে।
ননদ আবারও তাড়া দিয়েছিল, আচ্ছা আচ্ছা, বয়সের হিসেব পরে হবে, প্ৰবোর চাইতে তো আর বড় নয়? এখন বরণটা কর!
তদবধি বড় ননদকে দেবীজ্ঞান করে সুবর্ণ। সে যখন আসে, যেন হাতে চান্দ পায়। সে যে হিতৈষী, অন্য ননদদের মত ছুতো-ধরা নয়, সেটা বুঝতে দেরি হয় না। সুবর্ণর।
আজও তো সে ননদ সুবৰ্ণকে আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বলেছিল, তুই আমন হাবা কেন রে মেজ বৌ? চেয়ে-চিন্তে অখাদ্য ঘরখানা নিলি!
মেজ বৌ অবলীলায় বলেছিল, তা একজনকে তো নিতেই হবে।
কিন্তু এখন ননদের ভাইয়ের তীব্র প্রশ্নের উত্তরে অবলীলায় যা বললো সেটা অন্য কথা। এখন বললো, কেন, ঘরটা খারাপ কিসে? ভালই তো! একটা জানলা খুললে পড়াশীর ভাঙা দেয়াল, আর একটা জানলা খুললে গেরস্তের কলপাইখানা, মিটে গেল ল্যাঠা। সব দিক দিয়ে নিৰ্ভয়! পরপুরুষের সঙ্গে চোখোচোখির বাসনা থাকলেও সে বাসনা মিটবে না।
ওঃ! প্ৰবোধ তীব্ৰ চাপা গলায় বলে, সেই বিষ মনে পুষে আক্রোশ মেটানো হল! আচ্ছা!
সুবৰ্ণ বালিশটা উল্টে-পাল্টে ঠিক করতে করতে বলে, কথাতেই আছে সৎসঙ্গে স্বৰ্গবাস! বিষ-পুঁটুলির সঙ্গগুণে জমছে বিষ!
প্ৰবোধও পাল্টা জবাব দেয়, আমার মনে বিষ? আর নিজের জিভখানি? সে তো একেবারে বিষের ছুরি!
সুবৰ্ণ শুয়ে পড়ে বলে, তা সেটা যখন বুঝেই ফেলেছি, ছুরি-ছোরার থেকে সাবধান থাকাই মঙ্গল।
বটে? আমি পুরুষবাচ্ছা, আমি শালা সাবধান হতে যাবো পরিবারের মুখ আছে বলে?
তা হলে হয়ো না! সুবর্ণ অবলীলায় বলে, ছোটলোকের মতন হাড়াই-ডোমাই করো রাতদিন!
তবু তুমি তোমার জিভ সামলাবে না?
হক কথায় সামলাবো না।
হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে।
প্ৰবোধচন্দ্ৰ বীরপুরুষের ভঙ্গীতে উঠে বসে স্ত্রীর মাথার তালের মত খোঁপাটা ধরে সজোরে নেড়ে দিয়ে বলে, তোমার আসপদ্দার মাত্রা বাড়তে বাড়তে বড বেড়ে গেছে দেখছি! গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিতে পারি তা জানো?
তুমি আমার চুলের মুঠি ধরলে! সুবর্ণ উঠে বসে।
সুবৰ্ণর ফর্সা ধপধাপে গালের উপর বড় বড় কালো চোখ দুটো যেন জ্বলে ওঠে, ভয়ানক কিছু একটা বুঝি বলতে চায় সুবর্ণ, তারপর সহসাই গম্ভীর গলায় বলে, জানবো না কেন? খুব জানি। বাঙালীর মেয়ে হয়ে জন্মেছি, আর এটুকু জানবো না?
প্ৰবোধ বোঝে বেগতিক, গৃহপ্ৰবেশের সুখের দিনের রাতটাই মাটি। তাই সহসাই সুর বদলায়। নিতান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে এসে বলে, কেবল রাগ বাড়িয়ে দিয়ে মন্দ কথাগুলো শোনার সাধ। এই কটু কথাগুলো তুমিই মুখ দিয়ে বার করাও। আমি শালা এদিকে সারাদিন হাপু শুনছি কখন রাত আসবে, আর মহারাণী মেজাজ দেখিয়ে–নাঃ, তুমি বড্ড বেরসিক!
সুবৰ্ণর বয়েস চোদ্দ বছর।
অতএব প্ৰবোধের জয় হতে দেরি হয় না।
কিন্তু সে কি সত্যিই জয়?
জয় যদি তো অনেক রাত্রে পরিতৃপ্ত পুরুষটা, যখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে থাকে, ঘরের বাতাস উষ্ণ হয়ে ওঠে কেন একটা ভয়ঙ্কর আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাসে?
যে দীর্ঘশ্বাসটা কথা হয়ে উঠলে এই রকম দাঁড়ায়, এরা এরকম কেন? সারাজীবন এদের নিয়ে কাটাতে হবে। আমায়া!
কিন্তু এটা সুবৰ্ণলতারই বাড়াবাড়ি বৈকি।
সাধারণ ঘরসংসারী মানুষ এ ছাড়া আর কি হয়? সবাই তো এই কথাই জানে, মানুষকে খেতে হয়, ঘুমুতে হয়, বংশবৃদ্ধি করতে হয় এবং সেই কাজগুলো নিশ্চিন্তে সমাধা করবার উপায় হিসাবে টাকা রোজগার করতে হয়।
আবার খেটেখুটে ক্লান্ত হলে তাস-পাশা খেলতে হয়, মাছ ধরতে হয়, রকে বসে রাজনীতি করতে হয়, ছেলে শাসন করতে হয়, মেয়ের বিয়ে দিতে হয়, আর বুড়ো হলে তীর্থ-ধর্ম গুরুগোবিন্দ করতে হয়।
এরা জানে মাকে ভক্তি করতে হয়, স্ত্রীকে শাসন করতে হয় এবং সর্ব বিষয়ে মেয়েমানুষ জাতটাকে তবে রাখতে হয়। শুধু মুক্তকেশীর ছেলেরাই এরকম, একথা বললে অন্যায় বলা হবে। অধিকাংশই এরকম। তারতম্য যা সে কেবল ব্যবহারবিধিতে।
সুবৰ্ণ বৃথাই দুষছে তার শ্বশুরবাড়িকে। অকারণেই ভাবছে— হায়, মন্ত্রবলে সমস্ত পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে গিয়ে যদি মাঝখানের এই দিনগুলো মুছে যেত! যদি রাত পোহালেই দেখতে পেত সুবৰ্ণ, ন বছরের সুবর্ণ তাদের সেই মুক্তরামবাবু স্ত্রীটের বাড়ি থেকে স্কুলে যাচ্ছে বই-খাতা নিয়ে। সুবৰ্ণর মা হাসি-হাসি মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
একবার যদি এমন হয়, জীবনে আর কখনো সুবর্ণ তার ঠাকুমার ছায়া মাড়াবে না। ঠাকুমার কৃষ্ঠদেশের বাড়িতে একা না গেলে তো মাকে লুকিয়ে এমন হুট্ক্কারি বিয়ে দিয়ে বসতো না কেউ সুবর্ণর!
এতদিনে তা হলে হয়তো পাসের পড়া পড়তো সুবর্ণ।
না, মা কক্ষনো তার বিয়ে দিতো না তাড়াতাড়ি। বাবু বললেও না। ঠাকুমাই তার শনি। ঠাকুমা তাঁর সইয়ের মেয়েকে নাতনীর শাশুড়ী করে দিয়ে সইয়ের কাছে সুয়ো হলেন। সাধে কি আর ঠাকুমার কাছে যেতে ইচ্ছে করে না সুবর্ণর? মানুষটাকে যেন তার জীবনের শনি মনে হয়।
যেদিন বড় দুঃখ হয়, অপমান হয়, রাতদুপুরে এইসব চিন্তায় ছটুফট করে মরে সুবৰ্ণ, আর সমস্ত ছাপিয়ে মায়ের উপর একটা দুরন্ত অভিমানে দীর্ণ হতে থাকে।
মা তো দিব্যি চলে গেল!
সুবৰ্ণ মরলো কি বাঁচিলো একবার ভাবলও না। মা যদি কলকাতায় থাকতো, সুবৰ্ণকে এমন করে একদুয়োরী হয়ে পড়ে থাকতে হতো!