হ্যাঁ, নীচে সুবৰ্ণকে নেমে যেতে হয়েই ছিল। নীচের তলায় সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যের ছবি কল্পনাচক্ষে দেখার পর আর বসে থাকার সাহস হয় নি তার, শুধু অপরিসীম একটা ধিক্কারে দীর্ণবিদীর্ণ হতে হতে সে মনে মনে বলেছে, ভগবান তুমি সাক্ষী, বারান্দা দেওয়া ভাল বাড়ি আমি করবো করবো করবো! আমার ছেলেরা বড় হলে, মানুষ হলে, এ অপমানের শোধ নেব!
প্ৰতিজ্ঞা!
কিন্তু সুবৰ্ণলতার সেই আগের প্রতিজ্ঞা? ও যে বলেছিল, বারান্দা না থাকলে সে বাড়িতেই আমি থাকবোই না! হায় রে বাঙালী-ঘরের বৌ, তার আবার প্রতিজ্ঞা! শুধু চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মত বাড়ির মধ্যে সব থেকে ওঁচা ঘরটা নিজের জন্যে প্রার্থনা করেছিল বোকী অভিমানিনীটা।
বাড়ির পিছন দিকের উত্তর-পশ্চিম কোণের সেই ঘরটা কারুর প্রার্থনীয় হতে পারে এটা মুক্তকেশীর ধারণাতীত। ঘর বিলি করার ব্যাপ্তারে তিনি তখনো মনে মনে হিসেব করছিলেন। জ্যেষ্ঠর শ্রেষ্ঠ ভাগ এ নীতিতে বড় ছেলেকে পূর্ব-দক্ষিণের সেরা ঘরখানাই দিতে হয়, সেজ ছোট দুই ছেলেই তাঁর একটু শৌখিন। তা ছাড়া আজই না হয় তারা আইবুড়ো আছে, দুদিন বাদে তো বিয়ে হবে? তিনতলার ঘর থাকলে ভাল হয় তাদের। এদিকে আবার নিজেরও মাথা-গরমের বাতিক, ঘুপটি ঘরে ভয়, তাছাড়া তাঁর ঘরেই তো তার আইবুড়ো মেয়ের স্থিতি। খারাপট ঘরটা নিলে রেগে মরে যাবে না সে?
ওদিকে আবার মেয়ে-জামাই আসা আসি আছে। মেয়েদের আঁতুড় তোলা আছে। তাদের থাকা उभ0छ्।
খপ করে তাই কোনো কিছু ঘোষণা করে বসে নি মুক্তকেশী।
এহেন সময়, যখন খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে নিয়ে দোতলায় উঠেছেন তিনি, তখনই এই প্রার্থনা জানায় সুবৰ্ণ।
মুক্তকেশী একটু অবাক না হয়ে পারেন না, তারপর মনে মনে হাসেন। এদিকে একটু তর্কবাগীশ হলেও স্বার্থের ব্যাপারে বোকা-হাবা আছে বেঁটা! তবু বিস্ময়টা প্ৰকাশ করেন না। শুধু প্রীতিকণ্ঠে বলেন, তা এটাই যদি তোমার পছন্দ তো তাই থাক। তবে হাওয়া কি তেমন খেলবে? পেবোর একটু গরম হবে না?
ছেলের গরমের প্রশ্নই করেন মুক্তকেশী, বৌয়ের অবশ্যই নয়।
সুবৰ্ণ মাথা নেড়ে বলে, গরম আর কি, হাতপাখা তো আছেই।
তবে তাই! তোমার বিছনা-তোরঙ্গগুলো এ ঘরে তুলে দিক তাহলে।
তুলে দেবার লোক আছে।
ঝি খুদু একটা জোয়ান পুরুষের শক্তি ধরে। সেও তো এসেছে ঘোড়ার গাড়ির মাথায় চড়ে। খুদুর বলেই বলীয়ান মুক্তকেশী।
তা বলে বিছানা পেতে সে দেবে না, দোতলায় তুলে দিয়েই খালাস। সুবৰ্ণই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল, বিছানা পেতে নিল। নির্লিপ্ত নিরাসক্ত ভাবে।
কিন্তু প্ৰবোধের তো আর নিরাসক্তি আসে নি, তাই রাত্রে ঘরে ঢুকেই ফেটে পড়ে সে, শুনলাম মেজাগিনী শখ করে এই ওঁচা ঘরটা বেছে নিয়েছেন! মানেটা কি?
প্ৰবোধের বয়েস চব্বিশ, কিন্তু কথার বাঁধুনি শুনলে চল্লিশ ভাবতে বাধা হয় না। না হবে কেন, তিনপুরুষে খাস কলকাত্তাই ওরা—যে কলকাত্তাইরা ধান গাছের তক্তার প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পায় না, চাষ করে শুধু কথার।
তা ছাড়া মুক্তকেশীর ছেলেমেয়েদের সকলেরই ধরন-ধারণ পাকা পাকা। তারুণ্যকে ওরা লজ্জার বস্তু মনে করে, সভ্যতাকে বলে ফ্যাশান!
রুচি পছন্দ সৌন্দর্যবোধ এসব হাস্যকর শব্দগুলো ওদের অভিধানে নেই। আর জগতের সারবস্তু যে পয়সা এ বিষয়েও কারো দ্বিমত নেই। তা বলে সবাই যে লোক খারাপ তা মোটেই নয়। সুবর্ণর ভাসুর সুবোধ তো দেবতুল্য, সাতে নেই, পাচে নেই, কারোর সঙ্গে মতান্তর নেই, স্নেহ মমতা সহৃদয়তা সব কিছু গুণই তার মধ্যে আছে।
সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত মেজ ভাইকে মাঝে মাঝেই বকে সে, কী যে বলিস পাগলের মতন! মানুষ কি খাঁচার পাখী যে রাতদিন বন্ধ থাকবে? সবাই চিড়িয়াখানায় যাবে, মেজবৌমা যাবে না? এমন বাতিকগ্রস্ত হলি কেন তুই বল দেখি!
সুবোধের এই ক্ষুব্ধ প্রশ্নের ফলেই সুবর্ণর তার জা-ননদদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ঘটে, নচেৎ তো হয়েই গিয়েছিল বারণ।
যাত্রার তোড়জোড় শুনলেই তো রায় দিয়ে বসেন তার পতি পরামগুরু যে যায় যাক, তোমার যাওয়া-ফাওয়া হবে না!
কিন্তু দাদা বললে না করতে পারে না। সেটা আবার সেকালের শিক্ষার গুণ। যত অপছন্দকার ব্যাপারই হোক, বাপ-দাদার আদেশ ঠেলবার কথা ভাবতেই পারত না কেউ।
সুবৰ্ণ এর জন্যে ভাসুরের উপর কৃতজ্ঞ ছিল।
কিন্তু এদিকে এত উদার হলেও পয়সার ব্যাপারে কার্পণ্যের কমতি ছিল না সুবোধের। মাসকাবারী বাজার এনে মুটেকে দুটোর জায়গায় তিনটে পয়সা দিতে আধা ঘণ্টা বধকাব্যকি করতে আলস্য ছিল না তার, মুক্তকেশীর গঙ্গাস্নানের পালকি-বেহারারা দুই আনার বেশী পয়সা চাইলে তাদের নাকের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে দ্বিধামাত্র করতে দেখা যেত না।
দ্বিধা অবশ্য আরো অনেক কিছুতেই করে না সে। যেমন, বাড়ির বাইরের রকে গামছা পরে বসে তেল মাখতে দ্বিধা করে না, উঠোনের চৌবাচ্চার ধারে দাঁড়িয়ে স্নান করতে দ্বিধা করে না।
দেখে সুবর্ণর মনটা যেন কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে। এ যেন দেবদূতের গায়ে ছেঁড়া পোশাক, ফুলের গায়ে কাদা?
তবু ভাসুরকে সুবৰ্ণ ভক্তি করে।
ভক্তি করে বড় ননদকে।
সেই ছোট্ট বেলায় বেগুনী বেনারসী মোড়া সুবর্ণ যখন কাঁদতে কাঁদতে এদের বাড়িতে এসে দুধে-আলতার পাথরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ড়ুকরে উঠে বলেছিল, আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও গো, তোমাদের পায়ে পড়ি, তখন চারদিক থেকে ছি-ছিক্কারের অগ্নিবাণে সুবৰ্ণ তো প্ৰায় ভস্ম হতে বসেছিল, মুক্তকেশী তো এই মারে কি সেই মারে, সেই দুঃসময়ে ওই বড় ননন্দই রক্ষা করেছিল তাকে। বলেছিল, তোমরা সব কী গো! দুধের বাছা একটা, আর ভেতরের ঘটনাও জেনেছ সবাই, ওর প্রাণীটার দিকে তাকাচ্ছ না?