এরপর আর কি বলবে প্ৰবোধ? তবে চালাকি একটু খেলে সে। প্রতিদিনই প্ৰবোধ দেয় সুবৰ্ণলতাকে, হচ্ছে গো, শুধু বারান্দা হচ্ছে।
পরিণামে যা হয় হোক, এখন তো বাড়তি কিছু সুখলাভ হয়ে যাচ্ছে, সুবৰ্ণলতার মুখে আহাদের আলো খেলছে, সুবৰ্ণলতা উৎসাহে অধীর হচ্ছে, সুবৰ্ণলতা আত্মসমর্পণে নমনীয় হচ্ছে।
হচ্ছে।
চৌদ্দ বছরের সুবৰ্ণলতার পক্ষে এ সন্দেহ করা শক্ত ছিল, এমন জলজ্যান্ত মিথ্যে ধাপ্পা দেওয়া যায়। বরের প্ৰেম প্ৰীতি ভালবাসার পরিচয়ে মুগ্ধ হচ্ছে তখনও। আর কল্পনায় স্বৰ্গ গড়ছে।
চৌদ্দ বছরের সুবৰ্ণলতার পক্ষে এ সন্দেহ করা শক্ত ছিল, এমন জলজ্যান্ত মিথ্যে ধাপ্পা দেওয়া যায়। বরের প্ৰেম প্ৰীতি ভালবাসার পরিচয়ে মুগ্ধ হচ্ছে তখনও। আর কল্পনায় স্বৰ্গ গড়ছে।
এই ভাঙা পচা বাড়িটা ছেড়ে নতুন বাড়িতে গিয়েছে সে, বারান্দার ধারে চমৎকার সুন্দর একখানি ঘর, বড় বড় জানলা, লাল টুকটুকে মেঝে, সেই ঘরটিকে নিজের মনের মত সাজাবে সুবৰ্ণ। দেয়ালে দেয়ালে ছবি, তাকের উপর ঠাকুর-দেবতার পুতুল, বাক্স-প্যাটরায় ফুলকটা ঘেরাটোপ, ঝালর দেওয়া বালিশ, ফর্সা বিছানা। সেই ঘরে বসে কাথায় ফুল তুলবে সুবৰ্ণ চুপি চুপি লুকিয়ে, ভবিষ্যতের জন্যে।
কাঁথার প্রয়োজনের সূচনা নাকি দেখা দিয়েছে সুবর্ণর দেহের অন্তঃপুরে। সুবৰ্ণ বোঝে না। অতশত, গিনীরাই বোঝেন। ভয়ও করছে, বেশ একটা মজা-মজাও লাগছে।
অনেক দোলায় দুলছে এখন সুবর্ণ। ন বছরে এসেছে। এদের বাড়ি, সেই থেকেই স্থিতি, মা নেই, কেই বা নিয়ে যায়? বাপ সাহসই করে নি। পিসি একটা আছে কাছে-পিঠে, নিয়ে যেতে চেয়েছিল। একবার, এরা পাঠায় নি। এরা বলেছে, সে-কুলের সঙ্গে আর সম্পর্ক রেখে কাজ নেই। বাপ দেখতে আসে মাঝে-মধ্যেই ওই ঢের! তাও তো এদের সামনে ঘোমটা দিয়ে একবার দেখা। বোধ হয় সেই দুঃখে বাপও এখন আর আসে না বেশি। অতএব এদের নিয়েই থাকতে হবে সুবৰ্ণকে, তাই এদের মানুষ করে তুলতে ইচ্ছে করে সুবর্ণর। ইচ্ছে করে এরা শৌখিন হোক, সভ্য হোক, রুচি-পছন্দর মানে বুকুক। এদের নিয়ে সুন্দর করে সংসার করবে। সুবর্ণ।
রেষারেষি, ঝগড়াঝগড়ি, স্বাৰ্থ নিয়ে মারামারি, এসব দুচক্ষের বিষ সুবর্ণর, দু চক্ষের বিষ সারাক্ষণ ওই রান্নাঘরে পড়ে থাকাও। উদার আবহাওয়ার স্বাদ জানে না। এরা। জানে না বই পড়তে, পদ্য মুখস্থ করতে।. ভাবতে ভাবতে মনটা হারিয়ে যায় সুবর্ণর, মনে পড়ে যায় তার আকস্মিক বিয়েটার কথা। বিয়েটা না হয়ে গেলে হয়তো এতদিন পাসের পড়া পড়তো সুবর্ণ।
মা তো বলতো তাকে, তোকে আমি তোর দাদাদের মতন পাসের পড়া পড়াবো।
সুবৰ্ণর ভাগ্যে ভগবান তেঁতুল গুললো।
যাক, এই জীবনের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে সুবৰ্ণকে। আর দাঁড়ানোর প্রথম সোপানই তো সুন্দর একটা বাড়ি। পরিবেশটা সুন্দর না হলে জীবনটা সুন্দর হবে কিসের উপর?
চোদ্দ বছরের সুবৰ্ণর কাছে জীবনসৌন্দর্যের মাপকাঠি তখন ওই রাস্তা দেখতে পাওয়া বারান্দা দেওয়া একখানি ঘর।
বারে-বারেই সে তাই বরকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাগো, কতখানি চওড়া হচ্ছে?
বর ভুরু কুঁচকে বলে, তা অনেকখানি।
তা বেশ। কারণ হঠাৎ একটা বরকনে কি ঠাকুর গেল, সবাই মিলে দেখতে হবে তো বারান্দায় বুকে?
বীর তীক্ষ্ণ হয়।
বলে, সবাই তোমার মতন অমন বারান্দা-পাগল নয়।
তা সত্যি। সুবর্ণর চোখেমুখে আলো ঝলসে ওঠে, পাগলাই আছি আমি একটু! কী আহাদ যে হচ্ছে ভেবে! হ্যাগো, রেলিঙে সবুজ রঙ দেওয়া থাকবে তো?
তা সবুজ বল সবুজ, লাল বল লাল, তোমার ইচ্ছেতেই হচ্ছে যখন—
সুবৰ্ণ গলে পড়ে।
সুবৰ্ণ তার বরের মধ্যে সেই প্ৰেম দেখতে পায়, যা সে বইতে পড়েছে। বই অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়, শাশুড়ী ননদ দেখলে মেরে ফেলবে।
কিন্তু যোগান দেয় এদেরই একজন।
সুবৰ্ণর কাছে সে মানুষ দেবতা-সদৃশ। এদের সঙ্গে তুলনা করলে স্বর্গের দেবতাই মনে হয় তাকে সুবর্ণর। হায়, তার সঙ্গে যদি কথা কইতে পেত সুবর্ণ!
কইবার হুকুম নেই।
এদের রাশ বড় কড়া। বিশেষ করে প্রবোধ পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, তাকানো পর্যন্ত পছন্দ করে না। সুযোগ পেলেই যে মেয়েমানুষগুলো খারাপ হয়ে যায়, এ তার বদ্ধমূল ধারণা। ওই বই দেওয়াটা টের পেলে কী যে ঘটতো কে জানে! কিন্তু সুবর্ণ সাবধানী।
তবু সুবর্ণর ইচ্ছে করে সেই দেবতুল্য মানুষটার সঙ্গে একটু কথা কয়। কথা কইতে পেলে সুবর্ণ তাকেই পাঠাতো বাড়িটা কেমন হচ্ছে দেখতে, প্রশ্ন করতো— বারান্দাটা কি রং হলে ভাল হয়!
কিন্তু সে হবার জো নেই যখন, তখন বরের মুখেই ঝাল খাওয়া! যে বর বলেছে, বারান্দাৱ কথা দুঃমি এখন কাউকে গল্প করতে বোলো না। শুধু তুমি জানািচ্ছ। আর আমি জানছি, আর জানছে মিস্ত্রীরা!
কিন্তু তার পর?
গৃহপ্ৰবেশের দিন-ক্ষণ দেখে মুক্তকেশী যখন দুখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে আর লক্ষ্মীর হাঁড়ি কোলে করে সপরিবারে এসে উঠলেন নতুন বাড়িতে?
১.০২ মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়
মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়, ছেলে মেয়ে বৌ নাতি নিজে সবাইকে নিয়ে সদস্য-সংখ্যা মাত্র দশ, গৃহপ্ৰবেশ উপলক্ষে বিবাহিতা দুই মেয়ে আর কুচি একটা নাতনী এসেছে এই যা। এই কটা লোককে একখানা সেকেণ্ড ক্লাস ঘোড়ার গাড়িতে ভরে ফেলা খুব একটা শক্ত ছিল না, পুরুষ দু-তিনজন গাড়ির ছাতে উঠে বসলেই স্থান-সন্ধুলান এবং ভাশুর-ভদ্রবৌ সমস্যা, দুটোরই সমাধান হত। তবু যে হিসেবী মুক্তকেশী দুটো গাড়ির আদেশ দিয়েছিলেন সে কেবল লক্ষ্মীর হাড়ির শুচিতা বাঁচাতে।