যদিও বৌয়ের বয়েস মাত্র চোদ এবং তার বাইশ, তত্ৰাচ অসহিষ্ণুতায় খুব একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না। অন্তত বরপক্ষে তো নয়ই।
কিন্তু কথার ভটচায সুবৰ্ণলতাকে যে এই রাত্তিরেই যত কথায় পায়, তাই সে বলে ওঠে, আহা! কলিযুগে যেন অমর বর আছে! বলেছে আমি সধবা মরবো।
বাঃ, বেড়ো! তা এই সুখবরটি দিতে বোধ হয় বেশ কিছু বাগিয়ে নিয়ে গেছে তোমার কাছ থেকে?
আমার কাছ থেকে?
সুবৰ্ণলতা আকাশ থেকে পড়ে, আমি আবার কোথায় কী পাবো? মা সবাইয়ের হাত দেখালেন, চাল দিলেন, পয়সা দিলেন, নতুন গামছা দিলেন—
না, দিনের বেলায় নয়, দিনের বেলায় ছেলেমানুষ বৌ বরের সঙ্গে গল্প জুড়বে, এমন অনাচার আর যার সংসারে হয় হোক, মুক্তকেশীর সংসারে কদাপি ঘটতে পারে না।
এ নাটক রাত্রেরাই।
প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্য।
অবশ্যই বর এই মধুর ক্ষণটুকু এমন অকারণে অপব্যয় করতে রাজী নয়, তাই ওই তুচ্ছ কথায় যবনিকা টানতে বলে ওঠে, ভালই করেছেন। ওরা সব লোক সুবিধের নয়। ওদের সন্তুষ্ট রাখাই ভাল।
এ মন্তব্যের পরই বর একটু অনুচ্চ হাসির শব্দ শুনতে পায়।
সঙ্গে সঙ্গেই কঠোর গলায় বলে ওঠে, হাসলে যে?
এমনি।
এমনি মানে? এমনি কেউ হাসে?
পাগলে হাসে।
তা তুমি কি পাগল?
ছিলাম না, তোমাদের সংসারে এসে হয়েছি–চতুর্দশী সুবৰ্ণলতা প্ৰায় পাকা গিনীদের মতই ঝঙ্কার দেয়, দেখে-শুনেই পাগল। মার কোন কাজটাই বা তোমাদের কাছে ভুল? মা যদি ওকে কিছু না দিতেন, নিৰ্ঘাত বলতে, দেন নি বেশ করেছেন, যত সব ভণ্ড!
বলা বাহুল্য সুবৰ্ণ-পতি এতে খুব প্রীত হয় না, তীব্ৰস্বরে বলে, তবে কী করা উচিত? মাকে থো করে বৌয়ের পাদোদক খাওয়া?
সুবৰ্ণলতা দুৰ্গা দুৰ্গা করে উঠে বলে, যা নয়। তাই মুখে আনা! তার মানে আমায় রাগিয়ে দিয়ে কাজটি পণ্ড করার চেষ্টা। আমি কিন্তু রাগছি না, আমি হচ্ছি। ভবি। এই তোমার গা ছয়ে প্রতিজ্ঞা করছি সামনে বারান্দা না করলে তোমাদের সে বাড়িতে যাবই না। আমি।
বর তখনকার মত বলে, আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে। এখন শোও তো এসে।
অন্ধকারের আবরণ তাই রক্ষে, নইলে বরের আদরের ডাকে তরুণী পত্মীর বিরক্তি-তিক্ত মুখভঙ্গীটুকু দেখতে পেলে বোধ করি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত বর।
তবু গলাটায় মাধুর্যের ঘাটতি ধরতে পারলো বৈকি। সুবৰ্ণ যখন নীরস গলায় বলল, তোমার তো দেখা যাবে।! যা দেখবে তা জানাই আছে। একের নম্বরের মিথু্যক! বাড়ি করতে আর জমি পেল না— গলির মধ্যে! তখন সেও সমান নীরস গলায় বলে ওঠে, বাড়ি আমার একলার নয়। মাথার ওপর মা দাদা এদিকে ভাইয়েরা, আমি আবদার করিগে–ওগো আমার বৌ গড়ের মাঠের ওপর বাড়ি চায়। যত সব!
গড়ের মাঠ বলি নি আমি, শুধু বড় রাস্তাটা দেখতে চাই। মাথার ওপর ওপরওলা থাকলে একটা কথাও বলতে নেই বুঝি? আমি বলে রাখছি বারান্দা আমার চাই-ই চাই।
আমার চাই-ই, চাই!
বাঙালী গোরস্ত ঘরের বৌয়ের মুখের এই ভাষা! আসপদ্দা বটে একখানা! এত আসপদ্দা পেল কোথায় সুবৰ্ণলতা? এই কটা বছর শ্বশুরবাড়ির ভাত খেয়েই কি ওর মার ইতিহাস ভুলে গেছে? ভুলে গেছে তার লজ্জার গ্লানি? দিব্যি একখানি হয়ে উঠেছে।
আসপদ্দাটা তাহলে ওই জন্মসূত্রেই পাওয়া? তা ছাড়া আর কি? আরো তো বৌ রয়েছে
যখন-তখন তাই উদ্দেশে গালি পাড়েন মুক্তকেশী। কি করবো দুই বুড়ীই যে মরে হাতছাড়া হয়ে গেছে, নইলে আমার মাকে আর সইমাটিকে নিতাম এক হাত! নিজের নাতনীর গুণ জানতো না বুড়ী? জানতো, জেনে বুঝেই আমার গলায় এই অপরূপ মালাটি গছিয়ে দিয়েছিল। পূর্বজন্মের ঘোরতর শত্রুতা ছিল আর কি!
আবার এও বলেন কখনো কখনো, বুড়ীদের আর দোষ দিই কেন, মা-টির গুণই গাই। কেমন মা! আমড়া গাছে কি আর ল্যাংড়া ফলবে!
তবু সুবর্ণ তখনও চোটপাট উত্তর করতে শেখে নি। শাশুড়ী মায়ের প্রসঙ্গ তুললেই মরমে মরে যেত, আর শেষ অবধি যত আক্রোশ আর অভিযোগ গিয়ে পড়তো মায়ের উপরেই।
কেন, কেন তার মা আর সকলের মায়ের মত নয়? কেন তার মা স্বামীত্যাগ করে গৃহত্যাগ করে ছেলেমেয়ের মুখ হাসিয়ে গেছে?
সন্তানস্নেহ কিছুই নয় তা হলে? জেদটাই সব চেয়ে বড় তার কাছে? এমন কি একখানা চিঠি দিয়ে পর্যন্ত উদিশ করে না? সুবর্ণর যে অনেক বাধা সে কি মা বোঝে না? সুবর্ণ যদি তার মাকে একখানা চিঠি লিখতে বসে, বাড়িতে কোর্ট-কাছারি বসে যাবে না?
আইনজারি হবে না?
নিষেধাজ্ঞা?
একেই তো ওই অপরাধে কেউ তাকে দেখতে পারে না।
জবড়জং গাঢ় বেগুনী রঙা বেনারসী শাড়ি, আর জড়ির কলকাদার লাল মখমলের জ্যাকেট পড়া ন বছরের সুবৰ্ণলতা যখন ভাগ্যতাড়িতের মত এদের বৌ হয়ে এসে ঢুকলো, তখন তো একদিনেই তিন-তিনটে বছর বয়েস বেড়ে গেল তার। ঘরে পরে সবাই বলে উঠল, ন বছর? ওই ধাইপেয়ে দশাসই মেয়ের বয়স ন বছর? ন বছর ও তিন বছর আগে ছিল।
সেই বিরূপতার দৃষ্টি আজও ঘুচল না। সংসারের। বলতে গেলে পতিতের দৃষ্টিতেই দেখা হয়েছে তাকে। হতে পারে মা খারাপ হয়ে বেরিয়ে যান নি, তবু কুলত্যাগ, গৃহত্যাগ, স্বামীত্যাগ, এও কি সোজা অপরাধ নাকি?
তা অনেক দিন পর্যন্ত অপরাধিনী-অপরাধিনী হয়েই ছিল সুবর্ণ। তারপর দেখল। এরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম! যত নীচু হও ততই মাথায় চড়ে এরা, অতএব শক্ত হতে শিখল।
কিন্তু শক্র হয়ে কি রাস্তার দিকের বাবান্দা আদায় করতে পেরেছিল সুবৰ্ণ?
না, পারে নি।
ওর স্বামী প্ৰবোধ বুঝি চুপি চুপি একবার মায়ের কাছে তুলেছিল কথাটা, মুক্তকেশী বলেছিলেন, না না, ওর গোড়ে গোড় দিয়ে মরিস নি তুই পোবা! ঘরের ভেতর খেমটা নাচছে বৌ, আবার বারান্দায় গলা ঝোলালে আরও কত বড় বাড়বে তা আন্দাজ করতে পারছিস? তোর ভ্যাড়াকান্ত শ্বশুরটা পরিবারকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে শেষে পরিণামে কি ফল পেল দেখেছিস তো? চাই-ই চাই! মেয়েমানুষের মুখে এমন বাক্যি বাবার জন্মে শুনি নি।