সুবৰ্ণলতা সেই একবাড়ি লোকের সামনে মুক্তকেশীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। বলল, গহনা হারানোর কথায় কী বলেছেন??
মুক্তকেশী তাঁর মেজবৌমার অনেক মূর্তি দেখেছেন, কিন্তু ঠিক এ মূর্তিটি বোধ হয় দেখেন নি, তাই ফিসে গলায় বলেন, কী আবার বলবো?
বলেন নি, আমি সরিয়ে ফেলেছি?
মুক্তকেশী গালে হাত দেন, ওমা শোনো কথা! তোমার জিনিস, তুমি বলে কত আহ্লাদ করে ছোট ননদকে দেবে বললে, তোমায় ও কথা বলতে যাব কেন? ছিছি, আমি পাগল না। ভূত!
নিজের অভিনয়-ক্ষমতায় নিজেই প্রীত হন মুক্তকেশী।
সুবৰ্ণলতা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে, তবে যে রঞ্জা ঠাকুরঝি বলল?
মুক্তকেশী কথাটা লুফে নেন।
উদাস গলায় বলেন, তা তো বলবেই, জ্ঞাতি শতুর যে! জ্ঞাতির মুখেই এমন কথা শোভা পায়!
তবে আপনি কাকে সন্দেহ কর্চ্ছেন?
সন্দেহ আর কাকে করবো বাছা, করি আমার আদেষ্টকে! গহনার জন্যে এখন শ্বশুরবাড়িতে কত খোয়ার হয় দেখা মেয়েটার!
হবে বললেই তো হয় না— সুবৰ্ণলতা তীব্ৰস্বরে বলে, বার করতে হবে গহনা!
ওমা, বার করবো কোথা থেকে? হদিস জানি?
মুক্তকেশী হদিস জানেন না, কিন্তু মুক্তকেশীর বৌ সে হদিস বার করে ছাড়বে! মুক্তকেশীর ঘোমটা দেওয়া বৌ ঘোমটা মুখে সকলের সামনে মুখ তুলে চেঁচিয়ে ওঠে, আপনার ছেলে কই, মেজ ছেলে?
ওমা কী সর্বনেশে কথা, তাকে কী দরকার?
আছে দরকার।
তা এই একবাড়ি লোকের সামনে ডেকে কথা কইবে নাকি তুমি তার সঙ্গে?
কইব। কইতেই হবে। খুদু ডেকে আনো তো তোমাদের মেজদাদাবাবুকে।
চটি জুতোর শব্দ করতে করতে বাইরের ঘর থেকে ভিতরে এল প্ৰবোধ। অলস আদুরে গলায় শুধোলো, মা, ডেকেছ কেন গো?
মা নয়, আমি!
দর্জিপাড়ার গলির ওই বাড়িটায়। আর একটা বাজ পড়ল।
বুঝিবা এ কাজটা আরো ভয়ঙ্কর, আরো সাংঘাতিক।
মুক্তকেশীর পাশ কাটিয়ে, মুক্তকেশীর সামনে, একবাড়ি লোকের সামনে মুখের ঘোমটা কমিয়ে বরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৌ তীব্ৰ গলায় উচ্চারণ করল, মা নয়, আমি!
প্ৰবোধের মুখটা হঠাৎ অমন পাংশু হয়ে গেল কেন? প্ৰবোধ হুঙ্কার দিয়ে বৌকে থামিয়ে দিতে পারল না কেন? আমন বোকার মত শিথিল গলায় প্রশ্ন করল কেন, তার মানে?
সুবৰ্ণলতা কি সত্যই পাগল হয়ে গেছে? সুবৰ্ণলতা কি ভুলে গেছে সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কাদের সামনে? তা নইলে কি করে সুবৰ্ণলতা তেমনি স্বরেই বলতে পারে, মানে বুঝতে খুব কষ্ট হচ্ছে? গহনাগুলো কোথায় সরিয়েছ?
গহনা? আমি? কিসের গহনা? মানে—ইয়ে সেই গহনা? আমি কি জানি? বাঃ!
প্ৰবোধের জিভ তোৎলার অভিনয় শুরু করে।
কিন্তু মুক্তকেশী কি দাঁড়িয়ে ছেলের এই অপমান সহ্য করবেন?
তা তো আর হয় না।
মুক্তকেশী কনুইয়ের ধাক্কায় বৌকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেন, বাড়তে বাড়তে একেবারে যে আকাশে পা তুলছে মেজবৌমা। কাকে কি বলছো জ্ঞান নেই?
আছে। জ্ঞান ঠিকই আছে।–ধাক্কা খেয়েও নিবৃত্ত হয় না সুবৰ্ণলতা। বলে, খুব তো মাতৃভক্ত ছেলে আপনার, মায়ের পা ছুঁয়ে দিব্যি গালুক না, ও জানে কি না গহনা কোথায় আছে!
বেশ তাই করছি—, প্ৰবোধ মায়ের পা থেকে হাত চারের দূরে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছেড়ে, পা ছয়েই দিব্যি গালছি। ডরাই নাকি? ঐ্যা, এত বড় আস্পর্ধার কথা! আমি চোর, আমি গহনা চুরি করেছি!
চুরি করবে। কেন, সাবধান করেছ-, সুবৰ্ণলতা আরো তীক্ষ্ণ গলায় বলে, পাছে পরের ঘরে দামী জিনিসগুলো চলে যায়। তাই বাধা দিয়েছ। তোমায় চিনি না। আমি? দেব বলেছি বলে যাচ্ছেতাই কর নি তুমি আমায়? ধরে ঠেঙাও নি?
হ্যাঁ, এই চরমতম অপমানের কথা ব্যক্ত করে বসলো সুবৰ্ণলতা। পাছে লোক-জানাজানি হয়ে যায় বলে মার খেয়ে যে টু শব্দটি করে না, তার এই বলে বসাটা আশ্চর্য বৈকি!
এমনই ধৈৰ্যচ্যুতি ঘটলো সুবৰ্ণলতার যে, তার জীবনের এই লজ্জাকর গোপনীয় খবরটা এমন করে উদঘাটিত করে বসলো!
তা সুবৰ্ণলতার চরিত্রে হয়তো ওইটাই ছিল পরমতম ত্রুটি। সুবৰ্ণলতা যখন-তখনই ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে বসতো। সেই অতিক্রম করে বসায় যে নিজেই সে হাস্যাম্পদ হতো, হেয় হতো, সমালোচনার বিষয়বস্তু হতো, তা মনে রাখতে পারত না! সুবৰ্ণলতা যে তার ননদের গায়ে-হলুদের দিন গলায় আঁচল পাকিয়ে মরতে গিয়ে একটা কীর্তি করে বসেছিল, এতে কেউ সুবৰ্ণলতাকে মমতা করেছিল? না কি প্ৰবোধকে নিন্দে দিয়ে সত্যপথে স্থির তার বৌকে বাহবা দিয়েছিল?
মোটেই না। সুবৰ্ণলতাকে শুধু ছি-ছিক্কার করেছে। সবাই। কারণ সুবৰ্ণলতার জন্যে ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল সেদিন।
কী লজা! কী লজা!
মুক্তকেশীই কেন গলায় দড়ি দেন নি সেদিন, এই আশ্চর্য!
আচ্ছা বিরাজের বিয়েটা কি তবে বন্ধ হয়ে গেল?
ইস! পাগল নাকি?
মেয়ের বিয়ে বন্ধ হয়?
মা মরলে তাকে ঘরে শেকল তুলে রেখে দিয়ে লোকে কন্যাসম্প্রদানটা করে নেয়! এ তো তুচ্ছ একটা বৌ বাড়ির!
তা ছাড়া মরেও নি তো!
শুধু কেলেঙ্কারী করেছিল!
একবেলা শুয়ে পড়ে থেকেই তো সেরে গেল তার দুর্বলতা। আবার তো পরদিন উঠে কাজ-কর্ম করতে লাগলো বিয়েবাড়িতে। সবাইয়ের সঙ্গে খেতে বসতেও দেখা গেল মাছ লুচি নিয়ে। শুধু একটু বেশী শান্ত, একটু বেশী স্তব্ধ।
কিন্তু লজ্জিত কি?
আশ্চর্য, লজ্জিত হতে দেখা যায় নি কখনো সুবৰ্ণলতাকে! অথচ জীবনে কম কেলেঙ্কারী তো করে নি। সে! বারে বারে করেছে, যখন—তখন।
বিরাজের বিয়ে হয়ে গেল তা হলে? তবে বুঝি নিরলঙ্কার দেহে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দাঁড়াতে অনেক গঞ্জনা খেতে হয়েছিল বেচারাকে?