ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবেন!
চাদির ছুঁচ দিয়ে লোকের মুখ সেলাই করে দেবেন!
রাগে হাত-পা কাঁপতে থাকে প্ৰবোধের। সুশীলার অবশ্য এ ভাবান্তর চোখ এড়ায় না, তবে সুশীলা সে কথা তুলে আর ব্যাপারটাকে উদঘাটন করতে চায় না। তাড়াতাড়ি ভাইদের পাতের কাছে দুধের বাটিগুলো এগিয়ে দিয়ে গুড়ের বাটিটা নিয়ে আসে।
প্ৰবোধ একটা সুযোগ পায়, প্ৰবোধ এই ছুতোয় মনের উত্তাপ প্রকাশ করে বসে। দুধের বাটিটা বঁ হাতে ঠেলে দিয়ে বলে, লাগবে না, সরিয়ে নাও।
ওমা সে কী, কেন? পেট ভাল নেই?
পেট খারাপ শত্রুর হোক- প্ৰবোধ থমথমে গলায় বলে, এসব বাবুয়ানা ছাড়তে হবে এবার!
সুশীলা বুঝেও না বোঝার ভান করে, ফিকে গলায় বলে, হঠাৎ বাবুয়ানা কি দোষ করল!
প্ৰবোধ গুজগুঁজে গলায় বলে, যাদের এক পয়সার সংস্থান নেই, এক কথায় মেয়েদের গায়ের গহনায় হাত পড়ে, তাদের এমন দুধ ক্ষীর খাওয়া মানায় না।
বলে ফেলেই অবশ্য ঘাড়টা গুঁজে যায় প্ৰবোধের, কারণ ঠিক এমন স্পষ্টাস্পষ্টি কিছু বলে ফেলার ইচ্ছে তার ছিল না, চোরা গোপ্তা একটু ইশারা দিতে চেয়েছিল, হল না।
মায়ের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় বুকটা হিম হয়ে গেল তার। এরপর আর কি ও গহনা ছোঁবেন মুক্তকেশী?
কিন্তু মুক্তকেশী কি সুবৰ্ণলতা?
তাই অভিমানভারে সুবিধে-সুযোগ পণ্ড করবেন? না, সুবৰ্ণলতার মত বোকা নয় মুক্তকেশী। মুক্তকেশী। তাই তেতো গলায় বলে ওঠেন, তা ওই দুধ টুকু সরালেই সব সমিস্যের মীমাংসা হবে? না ওই বাঁচানো দুধ টুকু পুনরায় গরুর বাঁটে উঠে গিয়ে আবার পয়সা ফিরিয়ে আনবে? বাড়িতে কন্যেদায় উপস্থিত হলে, ঝি-বৌয়ের গহনায় হাত পড়ে না। এমন রাজার সংসার কাটা দেখেছিস তুই? মেজ বৌমা নিজে মুখ ফুটে বলেছে, সেইটুকুই আহ্লাদের, নইলে দরকারের সময় ছলে বলে কৌশলে নিতেই তো হতো! দিতে চেয়ে খুব একটা মহত্তর কিছু করে নি মেজ বৌমা। বড় বৌমারও থাকলে দিত।
অর্থাৎ প্ৰবোধের ঠেস দেওয়া কথার ফল হলো এই। সুবৰ্ণলতার মহত্ত্ব, উদারতা সব কিছুই এখন তৃতীয় বিভাগে পড়ে গেল, সুবৰ্ণলতার উঁচু মনের পরিচয়টা ধামাচাপা পড়ে গেল, সুবৰ্ণলতার সুখ্যাতিটা মাঠে মারা গেল।
মুক্তকেশী অতঃপর বসে বসে ফিরিস্তি দিতে লাগলেন এহেন ঘটনা আর কবে কোথায় দেখেছেন এবং কী রকম সোনাহেন মুখ করে সেই সব বৌরা গা থেকে গহনা খুলে দিয়েছে ননদের বিয়েতে, ভাশুরবির বিয়েতে।
তবে?
সবৰ্ণলতা কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নি সুবৰ্ণলতা এত কিছু বাহাদুরি দেখায় নি। সুবৰ্ণলতার মনটাকে যে উঁচু মন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন মুক্তকেশী, সে কেবল মুক্তকেশীর নিজের মন উঁচু বলে।
কিন্তু সুবৰ্ণলতার সেই মনের স্বীকৃতি কি রইল? বিরাজের গায়ে-হলুদের দিন যখন মুক্তকেশী মেজ বৌমার গহনার বাক্সটি তোরঙ্গ থেকে বার করলেন মেয়েকে সালঙ্কারা করবার জন্যে, তখন কি দর্জিপাড়ার ওই বাড়িটায় একটা বজ্রাপাত ঘটে গেল না?
দোয়াত আছে, কালি নেই।
বাক্স আছে, গহনা নেই।
মুক্তকেশীর ঘরে তোরঙ্গ, মুক্তকেশীর কোমরের ঘুনসীতে চাবি, অথচ মুক্তকেশীর অজানতে সে গহনা হাওয়া!
এ হেন ঘটনায় বিয়েবাড়িতে যতদূর হুলস্থূল হবার তো হয়েছিল বৈকি। বেশি বৈ কম হয় নি, কারণ বিয়েতে মুক্তকেশীর তিন বিবাহিতা মেয়ে এসেছে সপরিবারে, এসেছেন মুক্তকেশীর ভাজ, বোন, মাসতুতো বোন হেমাঙ্গিনী।
সকলে গালে হাত দিয়ে থ!
ভূত না চোর!
চোর যদি তো বাক্সটাসুদ্ধই নেবে, বাক্স খুলে আংটি মাকড়ি মল ইত্যাদি কুচকানো গহনা রেখে দিয়ে, বালা বাজুবন্ধ, চিক, সীতাহার, শাঁখা অনন্ত, পালিশ পাতের চুড়ি ইত্যাদি করে বড় বড় গহনাগুলি বেছে নিয়ে যাবে? এত সময় হবে চোরের?
তা হলে! হুঁ!
রাত-বিরেতে সিঁড়ির ছায়ায় কি উঠোনের ছাঁচতলায় ভূতের দেখা মেলে বলেই যে লোকে গহনা-চোর ভূতে বিশ্বাসী হবে এমন হয় না।
শেষ অবধি। তবে ঘরের মানুষ!
কে সেই মানুষটি?
কোন ঘরের?
মুখ মুখে কথা ফেরে, কথা কানে ইটে। অনেক কান ঘুরে সুবৰ্ণলতার কানে এসে পৌঁছয় উত্তরটা।
আর কে?
যার জিনিস সে।
হ্যাঁ, সে নিজেই। তা ছাড়া আর কি! সুখ্যাতি কিনতে লোক দেখিয়ে দানপত্তরে সই করে বসে হাত-পা কামড়ে মরছিল, অতএব তলে তলে পাচার। বাপের বাড়ি যাওয়া-আসা নেই! তাতে কি, এ বাড়িরই আনাচেকানাচে কোথাও সরিয়ে রেখেছে, পরে তাক বুঝে ব্যবস্থা করবে। দিয়ে ফেললে তো হাতছাড়া গোত্তরছাড়া!
সরিয়েছে কখন?
মৃত্যুর আবার ভাবনা কি, গঙ্গায়ানে যান না মুক্তকেশী। তাসের আড্ডায়?
চাবি?
সে অমন পাঁচটা চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ফেলা যায়। ভাঁড়ারের বাসনের সিন্দুকের মরচেধরা তালাটা খুলে দেয় নি সেদিন সুবৰ্ণলতা?
খুলে দিয়ে বাহাদুরী নেয় নি?
পান সাজিছিল সুবৰ্ণলতা, কাছে এসে কানে ঢেলে দিল। একজন কথাটা।
সুবৰ্ণলতা দাঁড়িয়ে উঠল।
বলল, কি বললে?
ও বাবা, এ যে নাগিনীর মত ফোঁস কর ওঠে গো! আমি বলি নি বাবা, বলেছে তোমারই শাশুড়ী।
কোথায় তিনি?
আরক্ত মুখ আগুনের মত গানগনিয়ে ওঠে, সামনে এসে মুখোমুখি বলবার সাহস হল না বুঝি?
জানি না। বাবা, তোমাদের কথা তোমরা জানো বলে জ্ঞাতি ননন্দ পালায়। ভেবেছিল কথাটা নিয়ে জ্ঞাতি জেঠির একটু নিন্দেবাদ করবে, ব্যাপার দেখে থেমে গেল, সরে পড়ল।
কিন্তু সুবৰ্ণলতা কি থেমে থাকবে?
সুবৰ্ণলতা কি তার মা সত্যবতীর রক্তে-মাংসে তৈরি নয়? যে সত্যবতী কখনো মিথ্যার সঙ্গে আপোস করে চলতে পারে নি, কখনো অন্যায় দেখে চুপ করে থাকে নি?