হুঁ। তা নেহাৎ ফ্যারফেরে ঝ্যারঝোরে জমি হলেও, বারো-তেরো টাকার কমে হবে বলে মনে হয় না।
বারো-তেরো!
মেজ ছেলে বিচলিত ভাবে চলে গেল। একবার নিজে একা টাকাটা বার করলে কি আর পরে ভাইদের কাছে চাওয়া যাবে।
তা হোক, কি আর করা যাবে? ক্রটি না থাকে। কেউ না ভাবে তাদের নজর নেই! দাদা খাটটার ভার নিক।
তা সেই ভাগাভাগি করেই খরচটা বহন করলো ছেলেরা। বড় ছেলে আনলো পালিশ করা খাট, মেজ ছেলে কালো ভোমরাপাড় গরদ। যে মানুষটাকে যখন তখন ষষ্ঠীমনসায় লালপাড় গরদ পরে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে, তার একখানা কালোপাড় গরদ হয় নি বলে আক্ষেপে মরে যাবে এমন ভাবপ্রবণতা অবশ্য কারো নেই, তবু দেখেশুনে কালো ভোমরাপাড়ই কিনে আনলো। বারো-তেরো কেন চোদ্দ টাকা পড়ে গেল। ঢালাপাড়ের চেয়ে নকশাপাড়ের দাম বেশি কিনা।
সেজ ছেলে নিজ মনেই আনলো ফুলের গাদা, আনলো ধূপের প্যাকেট, আনলো গোপালজল এক বোতল।
এসব কথা কবে নাকি বলে রেখেছিল সুবৰ্ণলতা। হয়তা ঠাট্টাচ্ছলেই বলেছিল। তবু সেই হেসে হেসে বলা কথাটাই মনে পড়ে মনটা কেমন করে ওঠা অসম্ভব নয়। সুবৰ্ণলতার সেজ ছেলে কথা বেশি বললো না। শুধু ধূপের গোছাটা জ্বলে দিল, শুধু ফুলগুলো সাজিয়ে দিল, আর গোলাপজলের সবটা ঢেলে দিল।
মড়ার গায়ে গোলাপজল ঢালা মুক্তকেশীর গোষ্ঠীতে যে এই প্রথম তাতে সন্দেহ কি?
মুক্তকেশীরই কি জুটেছিল? জুটেছিল শুধু একটা ফুলের তোড়া!
তাঁর মৃত্যুর দিন সুবর্ণই বলেছিল, একটা ফুলের তোড়া কিনে আন্ বাবা তোদের ঠাকুমার জন্যে। পৃথিবী থেকে শেষ বিদায় নেবার সময় সঙ্গে দেবার তো আর কিছুই থাকে না!
বলেছিল এই সেজ ছেলেটাকেই।
হয়তো সেদিনের স্মৃতি মনে জেগেছিল তার, আই অত ফুল এসেছিল। বিরাজ বলেছিল, মনে হচ্ছে তোদের মার বিয়ে হচ্ছে! বাসরের সোজ সাজালি মাকে। আমার শ্বশুরবাড়িতেও মরণে এত ঘটা দেখি নি।
নিজের শ্বশুরবাড়িটাকেই সর্ববিধ আদর্শস্থল মনে করে বিরাজ!
গিরিবালা বললো, যা বলেছ ছোট ঠাকুরঝি। এত দেখি নি বাবা!
গিরিবালার বাপের বাড়ির সাবেকী সংসারে এত ফ্যাশান এখনো ঢোকে নি। ওদের বাড়িতে এখনো বাসরেই ফুলের তোড়া জোটে না, তা শ্মশানযাত্রায়!
আজন্মের সাধ মিটলো সুবৰ্ণলতার।
কালো ভোমরাপাড়ের নতুন গরদ পরে রাজকীয় বিছানা পাতা নতুন বোম্বাই খাটে শুলো, আশেপাশে ফুলের তোড়া, গলায় গোড়েমালা।
পায়ে পরানো আলতার নুটি নিয়ে কাড়াকড়ি পড়ে গেল, মাথায় সিঁদুরের কণিকা প্ৰসাদ পাবার জন্যে হুড়োহুড়ি বাধলো। কেবলমাত্র নিজের বৌ-মেয়েরাই তো নয়, এসেছে ভাসুরপো-বৌ, তার দ্যাওরপো-বৌদের দল, এসেছে জা-ননদ, পাড়াপাড়শী বেয়ান-কুটুম।
সুবৰ্ণলতার শেষ যাত্রা দেখতে তো লোক ভেঙে পড়েছে।
এসেছে ধোবা গয়লা নাপতিনী যুঁটেওয়ালী সবাই। সকলেই অসঙ্কোচে ধুলোেকাদা পায়ে উঠে এসেছে দোতলায়, উঁকিঝুঁকি মারছে শবদেহের আশেপাশে। এটা বাড়ির লোকের পক্ষে বিরক্তিকর হলেও, এ সময় নিষেধ করাটা শোভন নয়। এরাও যে তাদের ময়লা কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে বলছে, এমন মানুষ হয় না!
চিরকাল বলেছে, এখনও বললো, এমন মানুষ হয় না!
এখন আর কোনোখানে কেউ বলে উঠলো না, তা জানি। ঘর-জ্বালানে পর-ভোলানে যে!
মৃত্যু সকলকে উদার করে দিয়েছে, সভ্য করে দিয়েছে।
আসন্ন সন্ধ্যার মুখে সুবৰ্ণলতার শেষ চিহ্নটুকুও পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গেল। চিতার আগুনের লাল আভা আকাশের লাল আভায় মিশলো, ধোয়া আর আগুনের লুকোচুরির মাঝখান থেকে সুবৰ্ণলতা যে কোন ফাঁকে পরলোকে পৌঁছে গেল, কেউ টের পেল না।
মানু বললো, এটা হোক। যা খরচ লাগে, আমি বেয়ার করবো!
মানুর দাদারা বললো, তা যদি করতে পারো, আমাদের বলবার কি আছে? ভালই তো।
প্ৰবোধ হাঁউমাউ করে কেন্দে বললো, কর বাবা, কর তোরা তাই। আত্মাটা শান্তি পাবে তার। এই সবই তো ভালবাসতো সে।
কে জানে মানুর এই সদিচ্ছা তার অপরাধবোধকে হালকা করে ফেলতে চাওয়া কিনা, অথবা অনেকটা দূরে সরে গিয়ে মা সম্পর্কে তার মনের রেখাগুলো নমনীয় হয়ে গিয়েছিল কিনা!
নিত্য সংঘর্ষের গ্লানিতে যে জীবনকে খণ্ড ছিন্ন অসমান বলে মনে হয়, দূর পরিপ্রেক্ষিতে সেই জীবনই একটি অখণ্ড সম্পূর্ণতা নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিস্তৃতির মহিমায়, ব্যাপ্তির মহিমায়। নিতান্ত নিকট থেকে যে আগুন শুধু দাহ আর উত্তাপের অনুভূতি দেয়, দূরে গেলে সেই আগুনই আলো যোগায়।
দূরত্বেই সম্ভ্রম, দূরত্বেই প্রত্যয়।
শ্রাদ্ধের শেষে ওই যে এনলার্জ করা ফটোখানা দেয়ালে বুলিলো অবিনশ্বর একটি প্ৰসন্ন হাসি মুখে ফুটিয়ে, ওই ছবির বংশধরেরা কি কোনোদিন সন্দেহ করবে, এ হাসিটুকু কেবল ফটোগ্রাফারের ব্যগ্র নির্দেশের ফসল!
মানু হয়তো দূরে চলে গিয়ে তার মায়ের রুক্ষ অসমান কোণগুলো ভুলে গিয়ে শুধু স্থির মসৃণ মূর্তিটাই দেখতে পেয়েছিল, কিন্তু পেল বড় দেরিতে। আর তখন কিছু করার ছিল না মানুর।
তাই মানু ভেবেচিন্তে ওই কথাটাই বললো, কাঙালী খাওয়ানো হোক এই উপলক্ষে!
খরচাটা সে একাই বহন করবে।
তবে আর বলার কি আছে? তা খরচ। আর ঝঞ্ঝাট দুটোরই ভার নিক।
তা নিল মানু। o অতএব সুবৰ্ণলতার শ্রাদ্ধে কাঙালীভোজন হলো। অনেক কাঙালী এল—আহ্বত, রবাহুত, অনাহুত। কাউকেই বঞ্চিত করলো না। এরা। আশা করলো, সুবৰ্ণলতার বিগত আত্মা পরিতৃপ্ত হলো এতে। বিশ্বাস রাখলো, ছেলেদের আশীৰ্বাদ করছে সুবৰ্ণলতা আকাশ থেকে।