এ উমাশশী জেঠি নয় যে, কোনো একটা কথায় ব্যঙ্গ হাসি দিয়ে দমিয়ে দেওয়া যাবে! হ্যাঁ, উন্মুখী হলে বলতে পারতো তারা শান্ত ব্যঙ্গের গলায়, খাটটা কি শুধুই পালিশের, না চন্দন কাঠের?
উমাশশী হলে বলতই।
কিন্তু ইনি উমাশশী নন, জয়াবতী। এঁর ব্যক্তিত্বই আলাদা। এর সামনে ছোট হতে পারা যাবে না, দৈন্য প্ৰকাশ করতে বাধবে।
তবু বাজেটের বিপদটাও কম নয়? মায়ের চিকিৎসা উপলক্ষেও তো কম খরচ হয়ে গেল না?
সব টাকা বাড়িতে ঢেলে, আর বহুদিন বাড়ি বসে বসে, প্ৰবোধের হাত তো স্রেফ ফতুর। টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন না। তিনি, যা করতে হবে ছেলেদেরই হবে। হয়তো বা বড় ছেলেকেই বেশি করতে হবে।
তাই বড় ছেলে শুকনো গলায় প্রশ্ন করলো, আপনি যদি বলেন। অবশ্যই আনা হবে জেঠিমা, তবে-ইয়ে বলছিলাম কি, ওটা কি করতেই হয়?
জেঠি আরো স্নিগ্ধ আরো ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, করতেই হয় এমন অসঙ্গত কথা বলতে যাবো কেন বাবা? এতো খরচার ব্যাপার আর কজন পারে? তবে তোমরা তিনটি ভাই কৃতী হয়েছে, তাই বলতে পারছি। সুবর্ণর অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল একখানি কালো ভোমরাপাড়ের গরদ শাড়ি পরে, আর একখানি ভাল খাট-গদিতে শোয়। মন খুলে কথা তো আমার কাছেই কইতো বেশিটা। কতদিন কথাচ্ছলে হাসতে হাসতে বলতো, জন্মে কখনো খাটে শুলাম না জয়াদি, মরে যখন ছেলেদের কাঁধে চড়ে যাবো, একখানা পালিশ করা খাটে শুইয়ে যেন নিয়ে যায় আমায়!
জন্মে কখনো খাটে শুলাম না!
খাটে!
জন্মে কখনো!
এ আবার কি অদ্ভুত ভাষা।
ছেলেরা অবাক হয়ে তাকালো।
মনশ্চক্ষে সমস্ত বাড়িখানার দিকেই তাকালো। তাকিয়ে অবাক হলো, হতভম্ব হলো। এত বড় বাড়ি, ঘরে ঘরে জোড়া খাট, অথচ সুবৰ্ণলতার এই অভিযোগ!
মরার পর আর কেউ গাল দিতে পারবে না বলেই বুঝি ছেলেদের সঙ্গে এই অদ্ভুত উগ্র কটু তামাশাটুকু করে গেছে সুবৰ্ণলতা!
বড় ছেলের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল সেই বিস্ময়-প্রশ্ন, জন্মে কখনো খাটে শোন নি!
জয়াবতী হাসলেন।
জয়াবতী থেমে থেমে কোমল গলায় উচ্চারণ করলেন, কবে। আর শুতে পেল বল বাবা! সাবেকী বাড়িতে যখন থেকেছে, তখনকার কথা ছেড়েই দাও। ইট দিয়ে উঁচু করা পায়াভাঙা চৌকিতে ফুলশয্যে হয়েছিল, কতদিন পর্যন্ত তাতেই কাটিয়েছিল। দর্জিপাড়ার নতুন বাড়িটা হবার পর ঘরে ঘরে একখানা করে নতুন চৌকি হয়েছিল।… খাট নয়, চৌকি। তা কোলের ছেলে গড়িয়ে পড়ে যাবার ভয়ে তাতেই বা কই শোয়া হয়েছে, বরাবর মাটিতেই শুয়েছে। তোমাদের অবিশ্যি এসব ভুলে যাবার কথা নয়।… তারপর যদি বা জেন্দাজেদি করে চলে এসেছিল। সেই গুহা থেকে, ঘরবাড়িও পেয়েছিল, কিন্তু ভোগ আর করলো কবে বল? তোমরা ষোটের সবাই পর পর মানুষ হয়েছে, বৌমারা এলেন একে একে, নিজের বলতে তেমন একখানা ঘরই বা কই রইল বেচারার? ওই ছোট একটু শোবার ঘর! রাতে আলো জুেলে বই পড়ার বাতিক ছিল ওর, অথচ তোমাদের বাবার তাতে ঘুমের ব্যাঘাত— একটু হাসলেন জয়াবতী, বললেন, প্ৰবোধ ঠাকুরপোর তবু বসতে দাঁড়াতে বৈঠকখানা ঘরটা আছে, ও বেচারার নিজস্ব বলতে কোথায় কি? শেষটা তো বারান্দায় শুয়েই কাটিয়ে গেল!
খুব শান্ত হয়ে বললেন বটে, তবু যেন শ্রোতাদের বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে গেল। আর তাদের পশ্চাদবর্তিনী বৌমাদের মুখ লাল হয়ে উঠল। তবে কথা তারা বলল না তাড়াতাড়ি। শুধু মেজ ছেলে আরক্তিম মুখে বলল, কাশির জন্যে মা নিজেই তো আর কারুর সঙ্গে ঘরে শুতে চাইতেন না!
জেঠি আরো নরম হলেন।
মধুর স্বরে বললেন, সে কী আর আমিই জানি না। বাবা! তোমরা তোমাদের মাকে কোনদিন অবহেলা করেছ, এ কথা পরম শত্রুতেও বলতে পারবে না। বহু ভাগ্যে তোমাদের মত ছেলে হয়। তবে কিনা মনের সাধ ইচ্ছের কথা তোমাদের কাছে আর কি বলবে? আমার কাছেই মনটা খুলতো একটু-আধটু, তাই ভাবলাম, এটুকু তোমাদের জানাই।
জেঠি বললেন, এটুকু তোমাদের জানাই!
জানার পর অতএব অজ্ঞতা চলে না!
অগত্যাই বাজেট বাড়াতে হলো।
মায়ের সাধের কথা ভেবে যতটা না হোক, ধনীদুহিতা জ্ঞাতি জেঠির কাছে নিজেদের মান্য রাখতেও বটে।
তবু বড় ছেলে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, নতুন জেঠিমার কথাটা শুনেছ?
বৌ উদার গলায় বললো, শুনেছি!
মানেটা ঠিক বুঝলাম না তো। মার গরদ শাড়ি ছিল না?
বৌ গম্ভীর গলায় বললো, মানে আমিও বুঝতে অক্ষম। তিন ছেলের বিয়েতে তিন-তিনখানা গরদ পেয়েছেন কুটুমবাড়ি থেকে!
আশ্চর্য! যাক কিনতেই হবে একখানা।
মেজ ছেলে বৌয়ের কাছে এল না, মেজবৌই বরের কাছে এল। মড়া ছুঁয়েছে বলে আর নিজ নিজ শোবার ঘরে ঢেকে নি, ছাদের সিঁড়ির ওধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে ব্যঙ্গের গলায় বললো, এই বেলা বলে রাখি, আমার একখানা পুষ্পহার পরিবার সাধ আছে! দিও সময়মত, নইলে আবার মরার পর ছেলেদের মুখে কালি দেব!
মেজ ছেলে শুকনো মুখে বললো, এটা যেন জেঠিমার ইচ্ছাকৃত ইয়ে বলে মনে হলো। অথচ ঠিক এরকম তো নন উনি!
মেজবৌ মৃদু হাসির মত মুখ করে বলে, কে যে কি রকম, সে আর তোমরা বেটাছেলে কি বুঝবে? জেঠিমার সঙ্গে কত রকম কথাই হতে শুনেছি—তা ছাড়া এয়োস্ত্রী মানুষকে কালোপাড় শাড়ী পরে শশানে পাঠানো? শুনি নি কখনো!
যাক যেতে দাও। ও-রকম একখানা গরদের কাপড়ে কি রকম আন্দাজ লাগবে বলতে পারো?
মেজবৌ ভুরু কুঁচকে বললো, তোমার ঘাড়েই পড়ল বুঝি!
মেজ ছেলে বোধ করি একটু লজ্জিত হলো। তাড়াতাড়ি বললো, ঘাড়ে পড়াপড়ি আর কি! একজন কাউকে তো যেতে হবে দোকানে। অবিশ্যি খুব ভাল খাপি জমি-টামির দরকারই বা কি? নেবে তো এক্ষুনি ডোমে!