শুধু সুবৰ্ণর মস্ত আইবুড়ো মেয়ে বকুল কান্দলো না একবিন্দু। কাঠ হয়ে বসে রইলো চুপ করে। বোধ হয় অবাক হয়ে ভাবলো জ্ঞানাবধি কোনোদিনই যে মানুষটাকে অপরিহার্য মনে হয় নি, সেই মানুষটা চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে এমন করে পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে কেন? সুবর্ণর বয়স্ক ছেলেরা প্রথমটা কেঁদে ফেলেছিল, অনেক অনুভূতির আলোড়নে বিচলিত হয়েছিল, সামলে নিয়েছে সেটা। তাদের দায়িত্ব অনেকখানি। এখন তারা বিষাদ-গম্ভীর মুখে যথাকর্তব্য করে বেড়াচ্ছে।
তাদের তো আর কাঠ হয়ে বসে থাকলে চলবে না। তাদের ভূমিকা গভীর বিষাদের। শিক্ষিত সভ্য ভদ্র পুরুষের পক্ষে ও ছাড়া আর শোকের বহিঃপ্রকাশ কি?
তবে হ্যাঁ, প্ৰবোধচন্দ্রের কথা আলাদা।
তার মত লোকসান আর কার?
প্ৰবোধ শোকের মত শোক করলো। বুক চাপড়ালো, মাথার চুল ছেঁড়ার প্রয়াস পেলো, মেঝোয় গড়াগড়ি খেলো, আর সুবৰ্ণলতা যে তার সংসারের সত্যি লক্ষ্মী ছিলো, আড়ম্বরে সে কথা ঘোষণা করতে লাগলো।
আস্তে আস্তে লাঠি ধরে এসেছিলেন ধীরে ধীরে বলেছিলেন, লক্ষ্মীছাড়া হলি এবার প্রবোধ।
সেই শোকবাক্যে প্ৰবোধ এমন হাঁউমাউ করে কেঁদে দাদার পা জড়িয়ে ধরেছিল যে, পা ছাড়িয়ে নিয়ে পালাতে পথ পান নি। সুবোধচন্দ্ৰ!
প্ৰবোধ হাঁক পেড়েছিলো, ও দাদা, ওকে আশীৰ্বাদ করে যাও!
সুবোধ বলেছিলেন, ওঁকে আশীৰ্বাদ করি আমার কী সাধ্যি? ভগবান ওঁকে আশীৰ্বাদ করছেন।
প্ৰবোধ এ-কথায় আরো উদ্দাম হলো, আরো বুক চাপড়াতে লাগলো। সেই শোকের দৃশ্যটা যখন দৃষ্টিকটু থেকে প্রায় দৃষ্টিশূল হয়ে উঠলো, তখন বড় জামাই আর ছোট দুই ভাইয়েতে মিলে ধরাধরি করে নিয়ে গেল এ-ঘর থেকে ও-ঘরে। জোর করে শুইয়ে দিয়ে মাথায় বাতাস করলো খানিকক্ষণ, তারপর হাতের কাছে দেশলাই আর সিগারেট কেন্সটা এগিয়ে দিয়ে চলে এলো।
মৃত্যুকে নিয়ে দীর্ঘকাল শোক করা যায়, মৃতকে নিয়ে দুঘণ্টাও নিশ্চিন্ত হয়ে শোক করা চলে না। আচার-অনুষ্ঠানের দাঁড়াদড়ি দিয়ে শোকের কণ্ঠরোধ করে ফেলতে হয়।
সমারোহ করে শেষকৃত্য করতে হলে তো আরোই হয়।
সুবর্ণলতার শেষকৃত্য সমারোহের হবে বৈকি! ভাল লালপাড় তাঁতের শাড়ি আনতে দিয়েছিল ছেলেরা, আনতে দিয়েছিল গোড়েমালা, গোলাপের তোড়া। ধূপ, অগুরু, চন্দন এসবের ব্যবস্থাও হচ্ছিল বৈকি। এ ছাড়া নতুন চাদর এসেছিল শ্মশানযাত্রার বিছানায় পাততে।
উমাশশী গিরিবালা বিরাজ বিন্দুর দল দালানের ওধারে বসে জটলা করছিলো। গিরিবালা বললো, সব দেখেশুনে মুখস্থ করে যাচ্ছি, বাড়ি গিয়ে ফর্দ করে রাখবো। মরণকালে বার করে দেব। ছেলেদের। গোড়ে গলায় না নিয়ে যমের বাড়ি যাচ্ছি না বাবা!
এই কৌতুক-কথায় মৃদু হাস্য-গুঞ্জন উঠল। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল তাকিয়ে দেখল, স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল।
তা। ওরা বোধ হয় একটু অপ্ৰতিভ হলো, বিরাজ তাড়াতাড়ি বললো, হ্যাঁ রে, পারুল তা হলে আসতে পারল না?
বকুল মাথা নাড়ল।
গিরিবালা বললো, মায়ের মৃত্যু দেখা ভাগ্যে থাকা চাই। এমন কত হয়, বাড়িতে থেকেও দেখা যায় না। দুদণ্ডের জন্যে উঠে গিয়ে শেষ দেখায় বঞ্চিত হয়।
বকুল ছেলেমানুষ নয়, তবু বকুল যেন কথাগুলোর মানে বুঝতে পারে না।
মায়ের মৃত্যু দেখা ভাগ্যে থাকা চাই?
দৃশ্যটা কি খুব সুখের?
বঞ্চিত হলে ভয়ঙ্কর একটা লোকসান? যে চোখ এই পৃথিবীর সমস্ত রূপ আহরণ করে করে সেই পৃথিবীকে জেনেছে বুঝেছে, সেই চোখ চিরদিনের জন্যে বুজে গেল, এ দৃশ্য মস্ত একটা দ্রষ্টব্য?
যে রসনা কোটি কোটি শব্দ উচ্চারণ করেছে, সেই রসনা একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেল, এ কী ভারি একটা উত্তেজনার?
হয়তো তাই।
ওঁরা বড়, ওঁরা বোঝেন।
উমাশশী বললো, তা খবরটা তো দিতে হবে তাড়াতাড়ি। চতুর্থী করতে হবে তো তাকে?
উমাশশীর এই বাহুল্য কথাটায় কেউ কান দিল না। এই সময় আস্তে ডাক দিলেন জয়াবতী, চাঁপা।
সুবৰ্ণলতার শেষ অবস্থা এ খবর সকলের আগে তার কাছে পৌঁছেছে আর সঙ্গে সঙ্গেই এসেছেন তিনি। যতক্ষণ সুবৰ্ণলতার শ্বাসযন্ত্র কাজ করে চলেছিল, ততক্ষণ মৃদু গলায় গীতার শ্লোক উচ্চারণ করেছিলেন জয়াবতী, একসময় দুটোই থেমেছে। তারপর অনেকক্ষণ কী যেন করছিলেন, একসময় চাঁপাকে বললেন, ভাইদের একবার ডেকে দাও তো মা!
চাপা তাড়াতাড়ি উঠে গেল।
ও-বাড়ির জেঠিমাকে সমীহ সেও করে বৈকি। বিলক্ষণই করে! জয়াবতীর শ্বশুরবাড়ির গুষ্টির সবাই করে।
একে তো সুন্দরী, তার ওপর আজীবন কৃন্ত্রসাধনের শুচিতায় এমন একটি মহিমময়ী ভাব আছে যে দেখলেই সম্ভ্রম আসে। বড়লোকের মেয়ে, সেই আভিজাত্যটুকুও চেহারায় আছে। ও-বাড়ির জেঠি। ডাকছেন শুনে ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে কাছে এল।
জয়াবতী শান্ত গলায় বললেন, একটি অনুরোধ তোমাদের করবো বাবা, রাখতে হবে।
সুবৰ্ণলতার ছেলেরা আরো ব্যস্ত হয়ে বললো, সে কী! সে কী! অনুরোধ কী বলছেন? আদেশ বলুন।
জয়াবতী একটু হাসলেন।
বললেন, আচ্ছা আদেশই। বলছিলাম তোমাদের মায়ের জন্যে কালো ভোমরাপাড়ের গরদ একখানি আর একখানি ভাল পালিশের খাট নিয়ে আসতে। এটা ওর বড় সাধ ছিল! পারবে?
শুনে ছেলেরা অবশ্য ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল, কারণ এমন অভাবিত আদেশের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তারা। এ একেবারে বাজেটের বাইরে। তা ছাড়া-সবই তো আনতে গেছে। শাড়ি, মালা, খাঁটিয়া।
কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে ওই শান্ত প্রশ্নের সামনে পারবো না বলাও তো সোজা নয়!