বলল, ভাগ্যি বটে! ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা! তার সাক্ষী দেখ, চার ভাইয়ের মধ্যে মেজবাবুই বংশছাড়া, গোত্রছাড়া। চিরটাকাল মেজগিনীর কথায় উঠেছেন বসেছেন।… আর শুধুই কি স্বামীভাগ্য? সন্তানভাগ্য নয়? ছেলেগুলি হীরের টুকরো, মেয়েগুলি গুণবতী! ভাগ্যবতী ভাগ্য জানিয়ে মরলোও তেমনি টুপ করে।
টুপ করে কথাটা অবশ্য অত্যুক্তি। স্নেহের অভিব্যক্তিও বলা চলে। তবু বললো।
বড় মেয়ে চাঁপাও কেঁদে কেঁদে আক্ষেপ করতে লাগলো, কর্পূরের মত উপে গেলে মা, প্রাণভরে দুদিন নাড়তে-চাড়তে অবসর দিলে না!
ছেলেরা বৌরা অবিশ্যি বড় ননদের আক্ষেপে মনে মনে মুচকি হাসলো। কারণ ঝাড়া হাত-পা গিন্নীবামী হয়ে যাওয়া চাঁপাকে অনেকবার তারা খোসামোদ করে ডেকেছে মাকে একটু দেখতে। শাশুড়ী বৌদের দূরে রাখতেন, যদি মেয়ে এলে ভাল লাগে!
চাঁপা তখন আসতে পারে নি।
চাঁপা তখন ফুরসৎ পায় নি।
চাঁপার সংসার-জ্বালা বড় প্রবল।
তখন চাঁপার শাশুড়ীর চোখে ছানি, পিসশাশুড়ীর বাত, খুড়শ্বশুরের উন্দরী, দ্যাওরপোদের হামপানবসন্ত, নিজের ছেলেদের রক্ত-আমাশা, হুপিংকাসি। তা ছাড়া চাঁপার ভাসুরঝির বিয়ে, ভাসুরপোর পৈতে, ভগ্নীর সাধ, মামাশ্বশুরের শ্রাদ্ধ, আর সর্বোপরি চাঁপার বরের মেজাজ। পান থেকে চুন খসবার জো নেই। গামছাখানা এদিক-ওদিক থাকলে রাক্ষসের মত চেঁচায়, তামাকটা পেতে একটু দেরি হলে ছাত ফাটায়।
চাঁপা অতএব মাতৃসেবার পুণ্যঅর্জন করতে পেরে ওঠে নি। ভাইয়েরা যখনই ডেকেছে চাঁপা তার সংসারের জ্বালার ফিরিস্তি আউড়ে অক্ষমতা জানিয়েছে।
তাছাড়া চাপা কোনোকালেই এটাকে বাপের বাড়ি ভাবে না।
চাঁপার সত্যিকার টান তো দর্জিপাড়ার গলির সেই বাড়িটার ওপর। যে বাড়িটার ছাতের সিঁড়ি আর গাথা হলোনা কোনোদিন। তা চাপা সে অভাব অনুভব করে নি কখনো, সুবৰ্ণলতার মেয়ে হয়েও না। চাঁপার প্রিয় জায়গা রান্নাঘর, ভাড়ার ঘর, ঠাকুমার ঘর, জেঠির ঘর!
চাঁপা ওইটেকেই বাপের বাড়ি বলে জানতো, চাপা সংসার-জ্বালা থেকে ফুরসৎ পেলে ওইখানে এসে বেড়িয়ে যেত।
হয়তো সেটাই স্বাভাবিক।
চাঁপার পক্ষে এ বাড়িকে আপনি বলে অনুভবে আনার আশাটাই অসঙ্গত।
এ বাড়ির কোথাও কোনোখানে চাপা নামের একটি শিশুর হামাগুড়ি দেওয়ার ছাপ আছে কি? চাপা নামের একটা বালিকার পদচিহ্ন?
এ বাড়িতে চাঁপার অস্তিত্ব কোথায়?
দর্জিপাড়ার বাড়িটা চাঁপার অস্তিত্বে ভরা। তার প্রত্যেকটি ইট চাঁপাকে চেনে, চাঁপাও চেনে প্রতিটি ইট-কাঠকে।
চাঁপা তাই বাপের বাড়ি আসবার পিপাসা জাগলেই চেষ্টা-যত্ন করে চলে আসতো। ওই দর্জিপাড়ার বাড়িতেই। ফেরার দিন হয়তো একবার মা-বাপের সঙ্গে দেখা করে যেত। কৈফিয়ত কেউ চাইত না, তবু শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, ঠাকুমা বুড়ীর জন্যেই ও-বাড়ি যাওয়া! বুড়ী যে কটা দিন আছে, সে কটা দিনই ও-বাড়িতে আসা যাওয়া! কবে আছে কবে নেই বুড়ী, চাপা চাঁপা করে মরে! ঠাকুমা মরলে বলেছে, মল্লিকাটার জন্যে যাই!
সুবৰ্ণলতা কোনোদিন বলে নি, তা অত কৈফিয়ৎই বা দিচ্ছিস কেন? আমি তো বলতে যাই নি, তুই ও-বাড়িতে পাঁচ দিন কাটিয়ে এ বাড়িতে দুঘণ্টার জন্যে দেখা করতে এলি কী বলে?
সুবৰ্ণলতা শুধু চুপ করে বসে থাকতো।
সুবৰ্ণলতা হয়তো কথার মাঝখানে বলতো, জামাই কেমন আছেন? বলতো, তোর বড় ছেলের এবার কোন ক্লাস হল?
চাঁপা সহজ হতো, সহজ হয়ে বাঁচতো। তারপর শ্বশুরবাড়ির নানান জ্বালার কাহিনী গেয়ে চলে যেত।
আবার কোনোদিন ও-বাড়ির খাবার দালানে গড়াগড়ি দিতে দিতে চাপা এবাড়ির সমালোচনায় মুখর হতো। তখন সমালোচনার প্রধান পাত্রী হলো চাঁপারই মা!
মায়ের নবাবী, মায়ের বিবিয়ানা, মায়ের গো-ব্ৰাহ্মণে ভক্তিহীনতা, মায়ের ছেলের বৌদের আদিখ্যেতা দেওয়া, আর কোলের মেয়েকে আস্কারা দেওয়ার বহর এই সবই হলো চাঁপার গল্প করবার বিষয়বস্তু।
চাঁপা সুবৰ্ণলতার প্রথম সন্তান, চাঁপা সুবৰ্ণলতাকে বৌ হয়ে থাকতে দেখেছে, অথচ দেখেছে তার অনমনীয়তা, আর দেখেছে বাড়িসুদ্ধ সকলের বিরূপ মনোভঙ্গী।
চাঁপার। তবে কোন মনোভাব গড়ে উঠবে?
তাছাড়া মায়ের নিন্দাবাদে দর্জিপাড়ার সন্তোষ, মায়ের সমালোচনায় দর্জিপাড়ার কৌতুক, মায়ের ব্যাখ্যানায় ওখানে সুয়ো হওয়া, এটাও তো অজানা নয় চাঁপার।
চাপা তাই ও-বাড়ির সন্তোষবিধান করেছে। এ-বাড়িকে কৌতুক করে।
হয়তো আরও একটা কারণ আছে।
হয়তো চাঁপাও ভিতরে ভিতরে মায়ের প্রতি একটা আক্রোশ অনুভব করে এসেছে বরাবর। চাঁপার শ্বশুরবাড়ির শাসন একেবারে পুলিসী শাসন, লোহার জীতার নীচে থাকতে হয় চাঁপাকে, চাঁপা তাই মায়ের সেই চিরদিনের বেপরোয়া অনমনীয়তাকে ঈর্ষা করে, মায়ের এই এখনকার স্বাধীনতাকে ঈর্ষা করে।
চাঁপার মনে হয়, চাঁপার বেলায় মা চাঁপাকে যেমন-তেমন করে মানুষ করেছে, কখনো একখানা ভাল কাপড়জামা দেয় নি, অথচ এখন ছোট মেয়ের আদরের বহর কত! কাপড়ের ওপর কাপড়, জ্যাকেটের ওপর জ্যাকেট।
চাঁপা ক্রুদ্ধ হয়েছে, অভিমানাহত হয়েছে।
কিন্তু এখন চাঁপা কেঁদে কেঁদে আক্ষেপ করছে, কর্পূরের মত উপে গেলে মা, একটু নাড়বারচাড়বার অবকাশ দিলে না।
হয়তো এই মুহূর্তের ওই আক্ষেপটাও সত্য। ওই কান্নাটুকু নির্ভেজাল, তবু ভাইবৌরা মনে মনে হাসলো।
অবিশ্যি বাইরে তারাও কাঁদছিল। না। কাঁদলে ভালো দেখাবে না বলেও বটে, আর চাঁপার কান্নাতেও বটে। কান্না দেখলেও কান্না আসে।