মুক্তকেশী অবাক গলায় যেন আর্তনাদ করে ওঠেন, বাবা নিয়ে যেতে চেয়েছিল? বলি কখন আবার নিয়ে যেতে চেয়েছিল মেজবোমা? স্বপ্ন দেখছ, না। স্বপ্ন দেখোচ্ছ?
স্বপ্ন দেখব কেন মা? ইচ্ছে করলেই মনে পড়াতে পারবেন। বিয়ের পর নিয়ে যাবার কথা বলেন নি। বাবা? আপনারাই বলেছিলেন, কুসঙ্গে পাঠাব না–
বলেছি, বলবই তো, একশোবার বলবো। মুক্তকেশী বলেন, নিত্যি যদি ওই হতচ্ছাড়া বাপের ঘরে যাওয়া-আসা করতে, তুমি কি আর এতদিন ঘরে থাকতে মা? কবে জুতো-মোজা পায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে! খবরের কাগজ পড়া মেয়েমানুষ তুমি, সোজা কথা?
বাবা রে গেলাম গো–সুবর্ণ কাতরে উঠে বলে, মায়া মমতা কী আপনাদের প্রাণে একেবারে দেন নি। ভগবান? মরে যাচ্ছে মানুষটা, তবু বাক্যযন্ত্রণা—
প্রস্তর-প্রতিমা উমাশশী হাঁ করে চেয়েছিল তার ছোটজায়ের দিকে।
কী ও?
মেয়ে না ডাকাত?
এত বড় দুঃসাহস কোথায় পেল ও? উমাশশীর যে দেখে শুনেই বুক কাপে, পেটের ভিতর হাত-পা সেঁধিয়ে যায়। সুবর্ণর শেষ কথায় হঠাৎ উমাশশীর সমস্ত স্নায়ূগুলো যেন একযোগে ছুটি চেয়ে বসলো।
উমাশশী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠল। কেন, তা সে নিজেই জানে না।
এই আদিখ্যেতায় মুক্তকেশী কি বলতেন কে জানে, কিন্তু বিপদমুক্ত করলো একটি শানানো ধারালো গলা।
এ গলা হাড়ি-বৌ গঙ্গামণির।
সুবৰ্ণর যন্ত্রণা শুরু হতেই খুদু গিয়েছিল তাকে ডাকতে।
বড়বৌয়ের কান্না শুনতে পেয়ে দালান থেকেই চিৎকার করে উঠেছে গঙ্গা, বলি হয়ে গেল নাকি? কান্নাকাটি পড়ে গেল যে?
বেয়াড়া আস্পদ্দাবাজ বেঁটাকে যতই গালমন্দ করুন, তার জন্যে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন বৈকি মুক্তকেশী, বিপদকাল বলে কথা! গঙ্গামণির গলার আওয়াজে মুক্তকেশী যেন হাতে চাঁদ পান!
আর মুহূর্তে ভোল বদলে যায়। তাঁর। অভিমানের গলায় বলে ওঠেন, এতক্ষণে এলি গঙ্গা? বৌ এদিকে এখন তখন!
গঙ্গা খরখারিয়ে ওঠে, তা কী করবো বাবু, তোমার নাতি হচ্ছে বলে তো আর এই গঙ্গামণি মরতে পারে না? পান সাজবো, দোক্তাপাতা গুঁড়োবো, পানদোক্তা গুলের কোটো আঁচলে বাধবো, দুয়োরে তালাচাবি নাগাবো, তবে তো আসবো!
মুক্তকেশী আরও অভিমানী গলায় বলেন, এখানে কী তুই পানদোক্তা। পেতিস না গঙ্গা?
হ্যাঁ, এদের কাছে মুক্তকেশী নোম নত। কারণ এদের নইলে আঁচল। এ বিপদের দিন তো আসবেই সংসারে। বছর বছরই আসবে।
গঙ্গার হাতিযশের নামডাক আছে, তাই গঙ্গার দস্তরমিত অহঙ্কারও আছে। রীতিমত অহঙ্কার আছে। এতটুকু এদিকও-ওদিক হলেই খরখর করে। পাঁচকথা শুনিয়ে দেবে, তেমন রাগ হলে প্ৰসূতিকে ফেলে চলে যাবে। নয়তো ইচ্ছে করে অবস্থা খারাপ করে দেবে।
তাই তোয়াজ করতেই হয়।
তাই গদগদ গলায় বলতে হয়, ক-কুড়ি পান খাবি খ্যা না!
খাব, পাঁচকুড়ি পান খাব। আগে তোমার নাতিকে পৃথিবীর মাটি দেখাই। কই গো বড়বৌমা, এক খুরি গরম জল দাও দিকি! হ্যাগা, তুমি কাঁদছ কেন? শাউড়ীর গাল খেয়েছ বুঝি? তা খেতে পারো, যা দজাল শাউড়ী! নাতি হলে ঘড়া বার করতে হবে, বুঝলে গিন্নী, ওর কমে ছাড়ব না!
গঙ্গামণির একটি চোটপাট কথা মুক্তকেশীল গা-সহা। তাই মুক্তকেশী চটে ওঠেন না। চেষ্টা করে হেসে বলেন, আচ্ছা, আন তো আগে। হবে তো একটা মেয়ের টিপি, বুঝতেই পারছি।
মেয়ে হলেও গামলা! মেজখোকার এই প্ৰেথম, তা মনে রেখো। গঙ্গামণি অতঃপর তার নিকষ-কৃষ্ণ বিপুল দেহখানি নিয়ে আসরে ওঠে।
গরম দুধ দাও দিকি, একটু গরম দুধ দাও, জোর আসবে দেহে। ন্যাকড়াকানির পোটলা কই গো? বালিশ আছে? চ্যাঁচাড়ি? মজুত রাখো হাতের কাছে।… বলি মেজবৌমা, অমন হাত-পা ছেড়ে দিয়ে নীলবনু হয়ে আছ যে! বুকে বল আনো, পেরাণে সাহস আনো, কষ্ট নইলে কি আর কেষ্ট মেলে?
কষ্ট নইলে কেষ্ট মেলে না!
অতএব কেষ্ট চাইতে হলে কষ্ট করতেই হবে।
কিন্তু শুধু যদি কষ্টই ওঠে ভাগ্যে, কেষ্টটি না মেলে?
মুখপাত প্রথম সন্তান হলো কি না মাটির ঢিপি এক মেয়ে? ছিছি!
মুক্তকেশী ক্রুদ্ধ গলায় বলে ওঠেন, জানতুম! গামলা পাবি না কচু পাবি!
চলেছিল যমে-মানুষে টানাটানির পালা। দীর্ঘসময় এই কষ্ট হয়রানি উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, তার ফলাফল কি না একটা মেয়ে! শাঁখ বাজবে না জেনেই বোধ করি চিলের মত চেচনির সাহায্যে পৃথিবীতে নিজের আগমনবার্তা নিজেই ঘোষণা করছে।
গঙ্গামণিও যেন অপ্ৰতিভ হয়।
নাতির ছলনা দেখিয়ে অনেক কথা বলে নিয়েছে! সত্যিই নাতিটি হলে মুখ থাকত!
এই তো মুক্তকেশী বলে উঠলেন, তুমি আর সঙের মতন শাঁখ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে না। বড়বৌমা, তুলে রেখে দাও গে! চোঁচানির শব্দ শুনেই বুঝেছি আসছেন একখানি নিধি!
সুবৰ্ণ এত কথা শুনতে পায় না, সুবর্ণ যেন চৈতন্য আর অচৈতন্যের মধ্যবতীর্ণ একটা অবস্থায় নিমজ্জিত। সুবৰ্ণ যেন দেখতে পাচ্ছে সুবর্ণর মা এসেছে মাথার কাছে, বলছে, ছেলে-মেয়ে দুই-ই সমান সুবর্ণ, হেলা করিস না।
সুবৰ্ণ হাত বাড়িয়ে মাকে ধরতে যায়, পারে না। হাত তুলতে পারল না বলে, না মা হারিয়ে গেল বলে?
হারিয়ে গেল।
সুবৰ্ণ আর তার মায়ের সেই দীর্ঘ ছাদের উজ্জ্বল মূর্তিটা দেখতে পেল না। শুধু সুবর্ণর সমস্ত প্ৰাণটা হাহাকার করতে থাকে।
সুবৰ্ণ কি স্বপ্ন দেখছিল?
কিন্তু মাকে কি সুবর্ণ এত বেশি মনে করে? মার উপর একটা রুদ্ধ অভিমান যেন সেই স্মৃতির দরজা বন্ধ করে রেখেছে। সুবর্ণর যে এদের সংসার ছাড়াও একটা অতীত ছিল, ভুলে থাকতে চেয়েছে সে কথা।