ছড়িয়ে পড়লো ভোরের আলো।
তুলে দেওয়া হলো বারান্দা-ঘেরা ত্রিপল আর চিক। দক্ষিণের বারান্দার পূব কোণ থেকে আলোর রেখা এসে পড়লো বিছানার ধারে। মৃত্যুর কালিমার উপর যেন সৌন্দর্যের তুলি বুলিয়ে দিল।
সুবৰ্ণলতার শেষ দৃশ্যটি সত্যিই বড় সুন্দর আর সমারোহের।
এ মৃত্যুতে দুঃখ আসে না, আনন্দই হয়।
কেন হবে না? যদি কেউ জীবনের সমস্ত ভোগের ডালা ফেলে রেখে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়, তার মৃত্যুটা শোচনীয়, সে মৃত্যু দুঃখের। আবার বয়সের বিষকীটে জীর্ণ হয়ে যারা শেষ পর্যন্ত অপরের বিরক্তির পাত্র হয়ে উঠে প্রতিনিয়ত জীবনকে ধিক্কার দিতে দিতে অবশেষে মরে, তাদের মৃত্যুটা নিশ্চিন্ততার, হাঁফ ছেড়ে বাঁচার! যেমন মরেছিলেন মুক্তকেশী।
মুক্তকেশীর উনআশী বছরের পুরানো খাঁচাখানা থেকে যখন বন্দীবিহঙ্গ মুক্তিলাভ করলো, তখন তাঁর আধাবুড়ো আর আধ-পাগলা ভাইপোটা লোক হাসিয়ে পিসিমা গো পিসিমা গো করে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদলেও, বাকী সকলেই তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছিল। মুক্তকেশীর পরম মাতৃভক্ত ছেলেরা পর্যন্ত।
সে তো শুধু মুক্তকেশীর প্রাণপাখীর মুক্তি নয়, ছেলেদের আর বৌদেরও যে পাষাণভার থেকে মুক্তি!
কিন্তু সুবৰ্ণলতার কথা স্বতন্ত্র।
সুবৰ্ণলতা পরিপূর্ণতার প্রতীক।
ফলে, ফুলে, ব্যাপ্তিতে, বিশালতায় বনস্পতির সমতুল্য।
এমন বয়সে আর এমন অবস্থায় মৃত্যু হলো সুবৰ্ণলতার যে, সে মৃত্যু অবহেলা করে ভুলে যাবারও নয়, শোকে হাহাকার করবারও নয়।
জ্বলজ্বলাট জীবন, জ্বলজ্বলাট মৃত্যু!
আজীবন কে না হিংসে করেছে সুবৰ্ণলতাকে? তার জায়েরা, ননদেরা, পড়শিনীরা, এরা-ওরা। সেই ছোট্ট থেকে দাপটের ওপর চলেছে সুবৰ্ণলতা! কাউকে ভয় করে চলে নি, রেয়াত করে চলে নি। আমন যে দুর্ধর্ষ মেয়ে মুক্তকেশী, তিনি পর্যন্ত হার মেনেছেন সুবৰ্ণলতার কাছে। সেই দাপটই চালিয়ে এসেছে সে বরাবর। ভাগ্যও সহায় হয়েছে। আশেপাশের অনেকের চাইতে মাথা উঁচু হয়ে উঠেছিল সুবৰ্ণলতার।
টাকাকড়ি, গাড়িবাড়ি, সুখ-সম্পত্তি, কী না হয়েছিল? সংসার-জীবনে গোরস্তঘরের মেয়েবৌয়ের যা কিছু প্ৰাৰ্থনীয়, সবই জুটেছিল সুবৰ্ণলতার ভাগ্যে।
তাই সুবৰ্ণলতার মৃত্যুতে ধন্যি-ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে। সবাই বললো, হ্যাঁ, মরণ বটে! কটা মেয়েমানুষ এমন মরা মরতে পারে?
কেউ কেউ বা বেশি কায়দা করে বললো, মরা দেখে হিংসে হচ্ছে! সাধ যাচ্ছে মরি!
আর হয়তো বা শুধু কায়দাই নয়, একান্তই মনের কথা। বাঙালীর মেয়ে জন্মাবধিই জানে জীবনে প্রার্থনীয় যদি কিছু থাকে তো ভাল করে মরা।
শাঁখা দিয়ে সিঁদুর নিয়ে স্বামীপুত্রের কোলে মাথা রেখে মরতে পারাই বাহাদুরি! বাল্যকাল থেকেই তাই ব্ৰত করে বর প্রার্থনা করে রাখে— স্বামী অগ্রে, পুত্ৰ কোলে, মরণ হয় যেন গঙ্গার জলে।
মৃত্যুবৎসা বিরাজ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, সেই যে বলে না-পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই-ভাগ্যের কথাতেও সেই কথাই বলতে হয়। মরে না গেলে তো বলবার জো নেই ভাগ্যবতী।? মেজবৌ গেল, এখন বলতে পারি কপালখানা করেছিল বটে! এতখানি বয়েস হয়েছিল, ভাগ্যের গায়ে কখনো যমের আঁচড়টি পড়ে নি। সব দিকে সব বজায় রেখে, ভোগজাত করে কেমন নিজের পথটি কেটে পালিয়ে গেল!
তা বিরাজের কাছে এটা ঈর্ষার বৈকি। বিরাজ চিরদিনই তা মেজবৌকে ভালবেসেছে। যেমন, ঈর্ষাও করেছে তেমন।
বিরাজের শ্বশুরবাড়ি অবস্থাপন্ন, বিরাজের বর দেখতে সুপুরুষ, তবু বিরাজের মনে শান্তি কোথায়? সর্বদাই তো হাহাকার।
কাছাকাছি বয়সে, একই সময়েই প্ৰায় সন্তান-সম্ভাবনা হয়েছে দুজনের, কিন্তু ফলাফল প্রত্যেকবারই দুজনের ভিন্ন। বড়লোকের বৌ বিরাজ, যেই একবার করে সেই সম্ভাবনায় ঐশ্বর্যবতী। হয়ে উঠেছে, তার জন্যে দুধের বরাদ্দ বেড়েছে, মাছের বরাদ্দ বেড়েছে, তার জন্যে ঝি রাখা হয়েছে। তবু পূর্ণতার পরম গৌরবে পৌঁছবার আগেই শূন্য কোল আর ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এসে পড়তে হয়েছে তাকে, সেবা খেতে, সাত্ত্বনা পেতে।
অথচ সুবৰ্ণলতা?
সুবৰ্ণলতা আঁতুড়ে ঢোকবার ঘণ্টা পর্যন্ত দৌড়-ঝাপ করে বেড়িয়েছে, দু-চার ঘণ্টার মেয়াদে হৃষ্টপুষ্ট একটা শিশুর আমদানি করেছে, আঁতুড়ঘরের সর্ববিধ বিঘ্নবিপদ অবহেলায় অতিক্রম করে যথানির্দিষ্ট দিনে ষষ্ঠীর কোলে একুশ চুপড়ি সাজিয়ে দিয়ে নেয়ে-ধুয়ে ঘরে উঠেছে।
সবটাই তো বিরাজের চোখের উপর।
বিরাজ গহনা-কাপড় ঝলমলিয়ে এসে বসতো, শ্বশুরবাড়ির মহিমার গল্পে পঞ্চমুখ হতো, বাপের বাড়ির সমালোচনায় তৎপর হতো, আর তারপর ভাইপো-ভাইঝিদের কোলে-কাখে টেনে তাদের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে, নিঃশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠতো গিয়ে।
আর আর তিন বৌয়ের ছেলেমেয়ে তবু সারু-মোটায় মিশানো, মেজ বৌয়ের সব কটি পাথরকুচি!
কত বা দুধ খেয়েছে সুবৰ্ণ, কত বা মাছ খেয়েছে? গোরস্থঘরের চারটে বৌয়ের একটা বৌ, আর সব বৌ কটাই তো একযোগে বংশবৃদ্ধির দায়িত্ব পালন করে চলেছে। উমাশশী সব আগে শুরু করেছিল, সব শেষে ছোট বৌ বিন্দুর সঙ্গে সারা করেছে।
তবু ওদের তিনজনের কোনো না কোনো সময়ে কিছু না কিছু ঘটেছে, শুধু অটুট স্বাস্থ্যবতী। মেজবৌয়ের জেঁওজ ঘরে কখনো চিড় খায় নি। সে কথা নতুন করে মনে পড়লো বিরাজের।
এসেছিল উমাশশী, গিরিবালা, বিন্দু।
সুবৰ্ণলতার মরণ দেখে হিংসে করল তারাও।