জেদী রুগী নিয়ে ভুগেছে এতদিন সবাই, চিকিৎসা করতে পারে নি সমারোহ করে, আর এখন তার জেদ মানা চলে না। এখন অভিভাবকদের হাতে এসে গেছে রোগী। অতএব দুদিনেই দুশো। কাণ্ড! যেখানে যত বড় ডাক্তার আছে, সবাইকে এক-একবার এনে হাজির করাবার পণ নিয়েছে যেন সুবৰ্ণলতার ছেলেরা। কদিন আগেই মানুকে চিঠি লেখা হয়েছিল? শেষ অবস্থা, দেখতে চাও তো এসো। মানুও এসে পড়লো ইতিমধ্যে। আর চিকিৎসার তোড়জোড়াটা সে-ই বেশী করলো।
বিয়ের ব্যাপারে মাকে মনঃক্ষুন্ন করেছিল, সে বোধটা ছিল একটু। এসে একেবারে এমন দেখে বড় বেশী বিচলিত হয়ে গেছে। তাই বুঝি ত্রুটি পূরণ করতে চায়।
প্রথমটা অবশ্য প্ৰবোধ অনুমতি নিয়েছে। সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে বলেছে, আর জেদ করে কি হবে মেজবৌ, চিকিচ্ছে করতে দাও! তুমি বিনি চিকিচ্ছেয় চলে যাবে, এ আপসোস রাখবো কোথায়?
মেজবৌ ওই ঘামের অবসন্নতার মধ্যেও যেন হাসে একটু, আপসোস রাখবার জায়গা ভেবে কাতর হচ্ছি? তবে তো জেদ ছাড়তেই হয়। কিন্তু আর লাভ কি?
লাভের কথা কি বলা যায়? মেজবৌকে এতগুলো কথা বলতে মেখে যেন ভয়টা কমে ভরসা। আসে প্ৰবোধের। তাহলে হয়তো সত্যি নিদানকাল নয়, সাময়িক উপসৰ্গ। নাড়ি ছেড়ে গিয়েও বেঁচে যায় কত লোক।
তাই ব্যস্ত হয়ে বলে, লাভের কথা কি বলা যায়? চামড়া ফুড়ে ওষুধ দেবার যে ব্যবস্থা হয়েছে আজকাল, তাতে নাকি মন্তরের কাজ হয়।
চামড়া ফুড়ে? সুবর্ণ এবার একটু স্পষ্ট হাসিই হাসে। নীল হয়ে আসা ঠোঁটের সেই হাসিটা কৌতুকে ঝলসে ওঠে, তা দাও।
পাওয়া গেল অনুমতি।
অতএব চললো রাজকীয় চিকিৎসা।
পরে আবার আপসোস রাখবার জন্যে জায়গা খুঁজতে হবে না। সুবৰ্ণলতার স্বামী-পুত্ৰকে।
শুধু চিকিৎসাতেই নয়, শেষ দেখা দেখতে আসার সমারোহও কম হল না। প্ৰবোধের তিনকুলে যে যেখানে ছিল, প্ৰবোধের এই দুঃসময়ের খবরে ছুটে এল সবাই। খবরদাতা বুন্দো। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এল। মেজ জেঠিকে সত্যই বড় ভালবাসতো ছেলেটা ছেলেবেলায়। সময়ের ধুয়োয় চাপা পড়ে গিয়েছিল সেই অনুভূতি। হঠাৎ এই শেষ হয়ে যাচ্ছের খবরটা যেন উড়িয়ে দিয়ে গেলো। সেই ধুলো।
তা বুদো বলেছে বলেই যে সবাই আসবে, তার মানে ছিল না। বুদো যদি নিজের মার শেষ খবরটা দিয়ে বেড়াতো, কজন আসতো?
সুবৰ্ণলতা বলেই এসেছে!
এটা সুবৰ্ণলতার ভাগ্য বৈকি।
এত কার হয়?
তা সুবৰ্ণলতার দিকে যে এরা সারাজীবন তাকিয়ে দেখেছে।
ভাগ্য সুবৰ্ণকে মগডালে তুলেছে, অথচ নিজে সে সেখান থেকে আছড়ে আছড়ে মাটিতে নেমে নেমে এসে ঘূর্ণি-ঝড় তুলেছে। এ দৃশ্য একটা আকর্ষণীয় বৈকি।
তাই তাকিয়েছে সবাই।
আর যার দিকে সারাজীবন তাকিয়ে থেকেছে, তার তাকানোটা জীবনের মত বন্ধ হয়ে যাবার সময় দেখবার সাধা কার না হয়?
আসে নি। শুধু তাদের কেউ, যেখান থেকে সুবর্ণ নামের একটা ঝকঝকে মেয়ে ছিটকে এসে এদের এখানে পড়েছিল। তাদের কে খবর দিতে যাবে? তাদের কথা কার মনে পড়েছে? কে বলতে পারে খবর পেলেও আসতো। কিনা? সেখানে তো অনেকদিন আগেই মৃত্যু হয়েছে সুবর্ণর।
কিন্তু প্ৰবোধের গুষ্টিও তো কম নয়।
তাতেই বিরাম নেই এই দুদিন।
এসে দাঁড়াচ্ছে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত চীৎকারে রোগিণীকে সম্বোধন করে আপনি আবির্ভাব সম্পর্কে অবহিত করে দিতে চাইছে, তাদের জানার জগতে মৃত্যুকালে কার কার এমন ঘাম হয়েছিল সেই আলোচনা করছে সেই ঘরে বসে, এবং রোগিণীর জ্ঞান-চৈতন্য নেইই ধরে নিয়ে হা-হুতাশ করছে।
তবে সকলেই কি?
ব্যতিক্রমও আছে বৈকি।
পুরুষরা সবাই এরকম নয়।
এদিক থেকে খবর নিয়েও বিদায় নিচ্ছে অনেকে।
জিজ্ঞেস করছে, কথা কি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে?… চোখ কি একেবারে খুলছেন না? গঙ্গাজল আছে তো হাতের কাছে? তুলসীগাছ নেই বাড়িতে?
শুভানুধ্যায়ীরই কথা!
কিন্তু স্বভাব যায় না মলে, এ কথাটা সত্যি বৈকি।
নইলে মৃত্যুর হাতে হাত রাখা মানুষটাও কারুর শত ডাকেও চোখ খুলছে না, আবার কারুর এক ডাকেই টেনে টেনে খুলছে চোখ।
ময়লা কাপড় ছেঁড়া গেঞ্জি পরা আধাবুড়ো দুলো যখন কাছে এসে ফুঁপিয়ে বলে উঠলো। মেজমামী! তখন তো আবার কথাও বেরোলো গলা থেকে! অস্পষ্ট, তবু শোনা গেল— পালাও, মারবে?
তা এ অবিশ্যি প্ৰলাপের কথা।
এক-আধটা অমন ভুল কথা বেরোচ্ছে মুখ থেকে।
তবে ঠিক কথাও বেরোচ্ছে।
বিরাজের বর যখন এসে বসেছিল মাথার কাছে, বিরাজ চেঁচিয়ে বলেছিল, মেজবৌ দেখ কে এসেছে! তখন আস্তে হাত দুটো জড়ো করবার বৃথা চেষ্টায় একবার কেঁপে উঠে বলেছিল, ন-মোস কার।
ভুলটা বাড়লো রাত্রের দিকে।
সারারাত্তির ধরে কত কথা যেন কইলা। কত যেন শপথ করলো। আবার একবার প্রবোধের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টই বললো-ক্ষমা!
ক্ষমা চাইলো?
না ক্ষমা করে গেল?
কে বলে দেবে সে রহস্য?
যারা কাছে ছিল তারা অবশ্য ধরেই নিলো ক্ষমা চাইলো। অনেক দৌরাত্ম্য তো করেছে স্বামীর ওপর!
কিন্তু তারপর এসব কথা বলছে কেন প্ৰলাপের মধ্যে?
বলেছিলাম। আর চাই না। যাবার সময় বলে যাচ্ছি, চাই। এই দেশেই, মেয়েমানুষ হয়েই!. শোধ নিতে হবে না?
কে জানে কি চাইছিল সে, কিসের শোধ নেবার শপথ নিচ্ছিল!
প্ৰলাপ! প্রলাপের আর মানে কি?
সারারাত যমে-মানুষে যুদ্ধ চললো। রাত্রিশেষে যখন পূব আকাশে দিনের আলোর আভাস দেখা দিয়েছে, তখন শেষ হলো যুদ্ধ।
পরাজিত মানুষ হাতের ওষুধের বড়ি আছড়ে ফেলে দিয়ে চীৎকার করে উঠলো। বিজয়ী যম নিঃশব্দে অদৃশ্যপথে অন্তৰ্হিত হলো, জয়লব্ধ ঐশ্বৰ্য বহন করে।