তুর মাঝে মাঝে সুবৰ্ণ খোঁজ নয়, তোর লেখাপড়ার কি হলো? মাস্টারকে বিদেয় করে দিয়েছে বুঝি?
বকুল মনে মনে বলে, ভগবান মিথ্যে কথায় দোষ নিও না—, মুখে বলে, অসুখ করেছে মাস্টার মশাইয়ের।
সুবৰ্ণ আর কথা বলে না, চোখটা বোজে।
বুঝতে পারা যাচ্ছে এবার শেষ হয়ে আসছে। যে মানুষ চিরটাদিন শুধু কথাই বলেছে, আর বলবো না প্ৰতিজ্ঞা করেও না বলে পারে নি— শুধু সংসারটি নিয়েই নয়, দেশ নিয়ে, দশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, সভ্যতা নিয়ে রাজনীতি ধর্মনীতি পুরাণ-উপপুরাণ সব কিছু নিয়ে কথা বলেছে, আর অপর কেউ তার বিপরীত কথা বললে তাল ঠুকে তর্ক করেছে, সে মানুষের যখন কথায় বিতৃষ্ণা এসেছে, তখন আর আশা করার কিছু নেই।
নেশাখোরের কাল সন্নিকট ধরা যায় তখন, যখন তার নেশার বস্তুটায় অনাসক্তি আসে।
সুবৰ্ণলতার কথা নেই, এই অস্বস্তিকর অবস্থাটা নিয়ে ছটফটিয়ে বেড়ায় তার চিরদিনের সব দুর্বাক্যের শ্রোতা, সব অভিযোগের আসামী। কালীঘাটে পূজো মানত করে আসে সে, ঠনঠনিয়া কালীর খাঁড়াধোয়া জল চেয়ে নিয়ে আসে।
মাটির ভাঁড়টা বিছানার অদূরে নামিয়ে রেখে ভাঙা-ভাঙা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে, এটুকু মাথায় বুলিয়ে খেয়ে ফেলো দিকি, কষ্টের উপশম হবে।
উপশম হবে? সুবর্ণ বলে, রাখো, রেখে দাও।
বেশীক্ষণ ওই রুগীর সামনে বসে থাকতে পারে না প্ৰবোধ, আসে যায়।
আবার ঘুরে এসে বলে, অভক্তি কোরো না মেজবৌ, একেবারে সদ্য খাঁড়া ধোওয়া।
২.২৯ সুবৰ্ণ একদিন উঠে বসে
সুবৰ্ণ একদিন উঠে বসে হাত বাড়িয়ে নিল জলটা, অনেকদিন পরে একটু হেসে বললো, তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, তাই না?
তা প্ৰবোধ চমকে গেল বৈকি।
ভালবাসার কথা তুলছে সুবর্ণ!
চমকে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকালো, ধারে-কাছে কেউ আছে কিনা দেখলো। তারপর কাছে সরে এসে কাঁদো কাঁদো ব্যাকুল গলায় উত্তর দিল, এতদিন পরে এই প্রশ্ন তুমি করছে আমায়? মুখ ফুটে বলতে হবে সে কথা?
নাঃ, সত্যিই সুবর্ণ বদলে গেছে।
হয়তো সুবর্ণ পৃথিবীকে ক্ষমা করে যাবে সংকল্প করেছে, তাই বলে উঠলো না— না, মুখ ফুটে বলতে হবে না বটে, সারাজীবন কাটা ফুটিয়ে ফুটিয়েই তো সেটা জানান দিয়ে এসেছ!
সুবৰ্ণ শুধু আর একটু হাসলো। তারপর বললো, না, বলতে হবে না অবিশ্যি। তবে ভালোই যখন বাসো, আমার একটা শেষ ইচ্ছে পূরণ করো না?
শেষ ইচ্ছে? প্ৰবোধ গেঞ্জিটা তুলে চোখ মোছে, তারপর বলে ওঠে, একশোটা ইচ্ছের কথা বল না তুমি মেজবৌ—
একশোটা মনে আসছে না। আপাততঃ একটাই বলছি–মেজ ঠাকুরবিকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে।
মেজ ঠাকুরঝি!
তার মানে সুবালা?
প্ৰবোধ যেন শূন্য থেকে আছাড় খায়।
মেয়ে নয়, জামাই নয়, নাতি-নাতনী নয়, ভাই-ভাইপো নয়, দেখতে ইচ্ছে হল। কিনা মেজ ঠাকুরঝিকে?
তাজ্জব!
তা তাজ্জব করাই পেশা ওর বটে।
বেশ, সেটাই হবে।
তড়বড় করে বলে উঠল প্ৰবোধ, এমন একটা আজগুবী ইচ্ছেই। যখন হয়েছে তোমার, তা সেই ব্যবস্থাই করছি।
প্ৰবোধের কথাটা অযৌক্তিক নয়, যে শুনলো সুবর্ণর শেষ ইচ্ছে, অবাকই হলো। আজগুবী ছাড়া আর কি? এত দেশ থাকতে চারটে ননদের মধ্যেকার একটা ননদকে দেখবো, এই হলো একটা মানুষের জীবনের শেষ ইচ্ছে? এই আবদারটুকু করেছে মুখ ফুটে?
তাও যদি সমবয়সী ননদ হতো!
হাস্যকর!
কিন্তু অভাগার ভাগ্যে বুঝি তুচ্ছও দুর্লভ!
সেখানেও তো মস্ত বাধা!
সুবালা যে তার শেষদিকের মেয়েগুলোকে ঝপাঝােপ। যা-তা বিয়ে দিচ্ছে! একটাকে চক্রবর্তরি ঘরে, একটাকে ঘোষালের ঘরে, একটাকে নাকি বারেন্দ্রর ঘরে, আবার শোনা যাচ্ছে ছোটটাকেও নাকি ওইরকম কি একটা ঘরে দেবে বলে তোড়জোড় করছে।
শহুরে নয়, ফ্যাশানি নয়, পয়সাওলা নয়। তবু এত সাহস! দেশে গ্রামে বসে এত স্বেচ্ছাচার!
মরুক গে যা খুশি করুক গে। ছেলেমেয়ের বিয়েতে পোস্টে একটা পত্তর দেওয়া ছাড়া যোগাযোগ তো ছিলই না, কে ওই রাবণের গুষ্টিকে এসো বোসো বলে ডাকবে? আসতে যেতে ভাড়া গুনতেই তো। ফতুর হতে হবে। সবাই ভেবে রেখেছিল, অতএব এই পত্তরখানাও এবার বন্ধ করতে হবে।
কিন্তু এখন আবার এই সমস্যা!
অথচ ঝপ করে কথা দিয়ে ফেলা হয়েছে মৃত্যুপথযাক্রিণীর কাছে। তার উপায়? এ সমস্যার সমাধান করলো কানু। বললো, এ তো আর আপনি কোনো সামাজিক কাজে আনছেন না বাবা, এতে আর কি হচ্ছে? মা যখন মুখ ফুটে বলেছেন—
ছেলের সমর্থন পেয়ে ভরসা পেলো কানুর বাবা।
অতএব সুবালা এল।
আনতে গেল ও-বাড়ির বুদো।
যে নাকি আশপাশের সকলেরই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো! কারে পড়ে প্ৰবোধ নিজে খরচাপত্তর ধরে দিয়ে অনুরোধ করে এল তাকে।
মেজ জেঠির শেষ অবস্থা! তোমায় দেখতে চেয়েছে!
এ খবর শুনে পর্যন্ত সেই যে কান্না শুরু করেছিল সুবালা, সে আর থামে না। চোখ মুছে মুছে আঁচলটা তার ভিজে শপৃশপে হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো ফুলে। লাল।
আরো দুটো দাঁত পড়ে, সারা মুখটাই যে তার আজকাল হাস্যকর বিকৃতির একটা প্রতীক! কেঁদে আরো কিন্তুতি!
বাড়ি ঢুকেই প্ৰবোধের পায়ে একটা প্ৰণাম ঠুকে উথলে উঠে বলে, আছে?
প্ৰবোধও উথলে বলে, আছে এখনও, তবে বেশীদিন থাকবে না।
বেশীক্ষণ নয়, বেশী দিন! তবু ভালো।
জ্ঞানে আছে?
তা টনটনে।
ঠাকুর রক্ষে কোরো! কথা-টথা বলছে?
বলছে অল্প স্বল্প।
অতএব একটু ঠাণ্ডা হয় সুবালা, চোখেমুখে জল দিয়ে রুগীর কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। প্ৰবোধ চড়া গলায় বলে, মেয়েগুলোর অঘরে-কুঘরে বিয়ে দিচ্ছিস শুনলাম—