কবরেজ পাড়ার লোক, সমীহ কম, প্ৰবোধ তিরিক্ষি গলায় বলে ওঠে, অসুখ নেই? অথচ সমানে শুনছি ঘুষয়ূষে জ্বর, কেসে কেসে অস্থির—
সুবৰ্ণলতা মাথা নেড়ে বলে, ও কিছু না।
কিছু না বলে তো জেদটি দেখাচ্ছে, এদিকে আত্মীয়স্বজন এসে আমায় গালমন্দ করে যায়। কবরেজ মশাই যখন এসেইছেন, একবার না হয় দেখেই যান না? খামোেকা দিন দিন শুকিয়েই বা যাচ্ছে কেন, সেটাও তো দেখা দরকার?
সুবৰ্ণলতা আরো দৃঢ় গলায় বলে, না, দরকার নেই। আপনাকে বৃথা কষ্ট দেওয়া হলো কবরেজ মশাই। আপনি আসুন গিয়ে।
অর্থাৎ আপনি বিদায় হন।
এমনি করে একদিন কুলপুরোহিতকে তাড়িয়েছিল।
ব্রজেন কবরেজ ফর্সা মানুষ, আরক্ত মুখটা আরো আরক্ত করে বলেন, বাড়িতে পরামর্শ করে তবে ডাক্তার-বদ্যিকে কল দিতে হয় প্ৰবোধবাবু!
প্ৰবোধবাবু ঘাড় হেঁট করে সঙ্গে সঙ্গে নেমে যান।
কবরেজ এসেছিলেন, দেখানো হয় নি কেন? বহুকাল আগে যেঙ্গপাড়ি ছেড়ে এসেছে ভানু, আজও অবিকল সে-বাড়ির একজনের মত মুখভঙ্গিমায় বলে উঠলো, এটার মানে?
সুবৰ্ণলতা সে মুখের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললো, দরকার নেই বলে।
দরকার আছে কি নেই, সেটা চিকিৎসকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলেই ভালো হতো না?
সুবৰ্ণ উঠে বসলো, স্থির গলায় বললো, সেই ভালোটা অবশ্যই তোমাদের? কিন্তু বলতে পারো, আজীবন কেবলমাত্র তোমাদের ভালোটাই ঘটবে কেন পৃথিবীতে?
কবরেজের মত মুখ করে ভানুও উঠে গেলো। বলে গেলো।— সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলাটাই এখন প্রধান কাজ হয়েছে তোমার!… আর এখনই বা কেন? চিরকালই!
খাতার নিচে চিরদিনের মত ঢেলা টেনে দিয়ে চলে গেল বলেই মনে হলো।
আশ্চর্য, একটা মানুষ শুধু মনের দোষেই খাক করলো সবাইকে!
রোগ হয় নি বলে কবরেজ তাড়ালে। অথচ চিরশয্যা পেতে শুয়ে আছে। মানেটা কি?
তা মানেটা আবিষ্কার করে বৌরা।
চুপিচুপি বলাবলি করে সেটা তারা।
দেখতেই তো পাওয়া যাচ্ছে রোগটা ভালো নয়, কাসি রোগ ছোঁয়াচে রোগ, তবু ডাক্তার কবরেজ দেখলেই তো হাতেনাতে ধরা পড়া, মেয়ের বিয়ে দিতে বেগ পেতে হবে, তাই—
তবু মানে একটা আবিষ্কার করেছে তারা, যেটির মধ্যে সুবৰ্ণলতার সৎবুদ্ধি আর সংসারের প্রতি শুভেচ্ছা দেখতে পেয়েছে তারা। পরের মেয়ে হয়েও পেয়েছে। বরং কারুর বৌ এটাও বলেছে, অতিরিক্ত অভিমানী মানুষ! অথচ বাবা একেবারে অন্য ধরনের—
কিন্তু এসব তো তারা সুবৰ্ণলতার সামনে বলে না যে সুবৰ্ণলতা টের পাবে, তাকে কেবলমাত্র মন্দবুদ্ধি ছাড়াও অন্য কিছু ভাবে কেউ কেউ।
তড়িঘড়ি রোগ নয়, তাই হুড়মুড়িয়ে দেখতে আসার কথা নয়। তবু চন্নন আজকাল মাঝে মাঝেই আসে। শ্বশুরবাড়িতে মনোমালিন্য চলছে, তাই ছুতো করে পালিয়ে আসে।
এসে মার কাছে বসে খানিকটা কুশল প্রশ্ন আর খানিকটা হা-হুতাশ করে উঠে যায়। থিয়েটার দেখার ঝোঁকটা প্রবল তার, সেই ব্যবস্থা করতেই ভজেদের কাছে আসা। ওখান থেকে যেতে গেলেই তো একপাল জা ননদের টিকিটের দাম গুনতে হবে, ভেতরে যতই মনোমালিন্য থাক, বাইরে সৌষ্ঠব না রাখলে চলে না।
এখানে ও বালাই নেই, বৌ দুটোকে নাচালেই হয়ে যায় ব্যবস্থা। গিন্নী-বানী একটা ননদ সঙ্গে যাচ্ছে দেখলে আপত্তি করে না বরেরা। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়েস তো হলো চন্নানের, ঝিয়ের সঙ্গে চলে যায়, টিকিট কেনার ঝামেলা ঝিকে দিয়েই মেটে।
থিয়েটার দেখে রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে তবে বিদায়গ্ৰহণ। কদাচ চাপাও এসে জোটে। তবে তার ফুরসৎ কম। শ্বশুরবাড়িতে ভারী শাসন।
চন্নন এসেছিল–
যাবার সময় আবার মার কাছে একটু বসে গায়ে পায়ে হাত বুলিয়ে বিদায় নেয়। চনুন। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আবার সময় পেলেই আসবো মা!
সুবৰ্ণলতা মেয়ের কথার উত্তর দেয় না। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কানুর দিকে তাকিয়ে ঘলে, ওদের সব বলে দিও কানু, আমার মরার আগে আর কারুর আসার দরকার নেই। মরলে পরে যেন আসে।
বললো এই কথা!
মরতে বসেও স্বভাব যায় নি!
পেটের মেয়েকে এই অপমান করলো। মানুষকে অপমান করে করে ওটাই যে পেশা হয়ে গেছে ওর!
কিন্তু মেয়ে বলে তো এই অপমানটা নীরবে হজম করতে পারে না চন্নন। ভাবতে পারে না রোগা মানুষের কথা ধর্তব্য নয়!
সেও আচ্ছা মনে থাকবে— বলে গটগটিয়ে গিয়ে গাড়িতে ওঠে। কানু পিছু পিছু যায় পৌঁছতে।
পরদিনই খবরটা চাঁপার কাছে পৌঁছে যায়। এবং বহুবার বলা কথাটাই আবার বলে দুজনে, আমরা সতীন-ঝি! আসল মেয়ে পারুলবালা আর বকুলবালা।
তদবধি মায়ের আদেশ পালন করেই চলছিলো তারা, আসছিল না, কিন্তু মরতে যে বড় বেশী বিলম্ব করলো সুবৰ্ণলতা।
কানুর ছেলের অন্নপ্রাশন ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে আট মাসে তুলেও যখন বিছানা থেকে তোলা গেল না। সুবৰ্ণকে, তখন প্ৰবোধ নিজেই হাল ধরে ঘটার আয়োজন করলো। নইলে লোকসমাজে যে মুখ থাকে না।
সেই সময় অনেক সাধ্য-সাধনা করে মেয়েদের নিয়ে এল প্ৰবোধ। তা তারা আমোদ-আহ্লাদে যাদুল্লামার কাছে ভার-ভার হয়েই থাকলো। শুধু যা একটু প্ৰণাম, তাও তো শোওয়া মানুষকে প্রণাম
বকুল বেচারা একবার দিদিদের দিকে, আর একবার মার দিকে ছুটোছুটি করতে লাগলো। পাছে কোনো এক পক্ষ চিরদিনের মত বেঁকে বসে।
কিন্তু বকুলের পরীক্ষা?
বকুলের জলপানি পাওয়া? তার কি হলো?
কিন্তু সে দুঃখের কথা থাক।
পড়া আর এগোলো কই তার? সুবর্ণই কারণ।
সুবৰ্ণলতা পৃথিবীর দিক থেকে পিঠ ফিরিয়েছে, তবু যা বকুলকেই এখনো খুব ঠেলে সরায় নি। বকুল যদি দুধটা-সাবুটা এনে দাঁড়ায়, হাত বাড়িয়ে নেয়। আর কেউ আনলেই তো বলে, রেখে যাও, খাবো।