সুবৰ্ণর সেই দীর্ঘ কালো চোখ দুটো কোটরে বসে গেছে, তবু বুঝি সে চোখ আজও কথা বলতে ভুলে যায় নি। সেই চোখের কথার সঙ্গে মুখের কথাও মেশায় সুবর্ণ, যে ফেলে চলে গেছে, সে তোমাকে আজও ভরে রেখেছে। জয়াদি, তোমার নির্বান্ধব হবার ভয় নেই।
বুঝলাম, খুব জ্ঞান দিলি। তবু দুটো মনের কথা বলারও তো সঙ্গী দরকার? আর তুই কি শেষটা হার মেনে চলে যাবি?
পণ ছিল হার মানব না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার যে সুবর্ণর ওপর বড় আক্রোশ, আর পারছি না। সেবা-যত্নের কথা বলছে জয়াদি, যে যা করতে আসে, কেউ কি অন্তর থেকে করে? সবই লোকদেখানো!
জয়াবতী হেসে ফেললেন। বললেন, চোখে যেটা দেখা যায় সেটাই দেখতে হয়। সুবর্ণ, অন্তরটা দেখতে যাওয়া বিধাতার বিধানের ব্যতিক্ৰম।
সুবৰ্ণ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে, থাক জয়াদি, ও নিয়ে তর্ক করা বৃথা। এ কাঠামোয় নতুন করে আর কিছু হবে না। তার চাইতে তুমি যা সব দেখে এলে তার কথা বলো।
জয়াবতী ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, সে আর বিশদ করে বলতে ইচ্ছে নেই সুবর্ণ। তোর কাছে চিরকালের লজ্জা রয়ে গেল আমার। তীৰ্থ করেছি না। রাতদিন অপরাধের ভারে মরমে মারে থেকেছি–
ওমা শোনো কথা—, সুবর্ণ ওকথা চাপা দিতে চেষ্টা করে; কিন্তু জয়াবতী কথাটা শেষ করেন, শুধু আমি একা হলে তোকে ফেলে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। কিন্তু দল বড় ভয়ানক জিনিস! ও জিনিসের মায়া থাকে না, মমতা থাকে না, চক্ষুলজ্জা থাকে না। যাব না বললে খেয়ে ফেলতো আমায়। আমিই তো উয্যুগী।
সুবৰ্ণ বলে, যাবে না কি বল? তীৰ্থ বলে কথা! মহাতীৰ্থ! জীবনে দুবার সুযোগ আসে না, আমার ভাগ্য আমায়—
হ্যাঁ, এই একটা জায়গা যেখানে সুবর্ণ সাধারণ মানুষের মত কথা কয়। ভাগ্য নিয়ে আক্ষেপ করে।
ঠাকুরপোর অসুখ যে শক্ত নয়। সে আমি বুঝেছিলাম। জয়াবতী একটু চুপ করে থেকে বলেন, তবু যাওয়া আটকাতো না। যদি ছেলেরা প্রতিকূল না হতো।
সুবৰ্ণ হঠাৎ হেসে ওঠে।
খাপছাড়া ভাঙা-ভাঙা।
শোনো কথা! জন্মলগ্নই যার প্রতিকূল, তার আবার কে অনুকূল হবে? তা এইটাই হয়তো ঠিক কথা।
জন্মলগ্ন নাকি তার রাশি-নক্ষত্রের সৈন্যসামন্ত নিয়ে আজীবন তাড়া করে বেড়ায় মানুষকে, এটা একটা অঙ্কশাস্ত্রের কথা।
কথায় ছেদ পড়লো।
এক হাতে গেলাস, এক হাতে রেকবি নিয়ে এসে ঢুকলো ভানুর বৌ। সহাস্যে বললো, জেঠিমা তীৰ্থ থেকে ফিরেছেন, আজ কিন্তু আপনাকে জল না খাইয়ে ছাড়বো না। দেখুন। আমি তসর কাপড় পরে, পাথরের বাসনে করে নিয়ে এসেছি।
জয়াবতী স্মিতমুখে বলেন, না জিজ্ঞেস করে এসব করতে গেলে কেন গো পাগলি মেয়ে! আজি যে আমার সঙ্কটা, কিছু খাব না তো!
কিছু খাবেন না?
না গো মা-জননী, কিছু না। দেখো দিকি, শুধু শুধু কষ্ট পেলে।
দুঃখের আর অবধি থাকে না বড়বৌমার, ম্লানমুখে চলে যায়।
চলে গেলে সুবৰ্ণলতা বলে, তুমি তো বেশ অভিনয় করতে পারো জয়াদি!
জয়াবতী হেসে বলেন, উপায় কি? জগৎটা তো থিয়েটারই। তুমি অভিনয় করতে পারলে না। বলেই হেরে মরলে!
সুবৰ্ণলতা আস্তে ওঁর হাতটা মুঠোয় চেপে ঈষৎ চাপ দিয়ে বলে, হেরেছি, কিন্তু হার মানি নি।
জয়াবতী উঠছিলেন, প্ৰবোধ এসে দাঁড়াল, হৈ-চৈ করে বলে উঠল, এই যে নতুন বৌঠান, তীর্থটীৰ্থ হলো? ভালো ভালো। তা দেখছেন তো আপনার সইয়ের অবস্থা? অথচ এক পুরিয়া ওষুধ খাবে না, সেবা যত্ন নেবে না। আবার এই খোলা জায়গায় এসে শোওয়া। নিজের দোষেই প্ৰাণটা খোওয়াবে মানুষটা।
সুবৰ্ণলতা হঠাৎ দারুণ কাসতে থাকে।
থামতেই চায় না।
প্ৰবোধ ভয়ার্তা মুখে চেঁচিয়ে ওঠে, এই বকুল, কোথায় থাকিস সব? রোগা মানুষ, একটু জলও— আচ্ছা আমি দেখছি— বলে বোধ করি নিজেই জলের চেষ্টায় বেরিয়ে যায়।
২.২৮ গঙ্গার জল কত বাড়লো
গঙ্গার জল কত বাড়লো, পৃথিবীর গতি কত বদলালো, তবু সমোজ-সামাজিকতার লৌহনিগড় থেকে নেয় না বুড়ো-বুড়ীরা। শ্যামাসুন্দরীকে এখন কেউ সামাজিকতা করলো না বলে নিন্দে করবে না, তবু তিনি কানুর খোকা হয়েছে শুনে রূপোর ঝিনুকবাটি নিয়ে মুখ দেখতে এলেন। অর্থাৎ চিরকাল যা করে এসেছেন তা করবেন। সবাই বকতে লাগলো।
উনি বললেন, তা হোক তা হোক। প্ৰবোধের এই প্রথম পৌত্তুর। বড় নাতবৌ তো প্ৰথম মেয়ে দেখিয়েছে।
পৌত্তুর!
তাই বটে।
জিনিসটা আরাধনার।
অথচ সুবৰ্ণলতা বেহুঁশ হয়ে বসেছিল। সোনার হার দিয়ে মুখ দেখার কথা যার। নিজের ক্রটি দেখে না। সুবর্ণ, কেবল পরের ক্রটিই টের পায়।
সে যাক, শ্যামাসুন্দরীর ছানি পড়ে আসা চোখেও অবস্থাটা ধরা পড়লো। প্ৰবোধকে ডেকে বললেন কথাটা, বৌমার কি হাল প্ৰবোধ? ডাক্তার-বদ্যি কিছু দেখিয়েছো?
প্ৰবোধ মাথা চুলকে বলে, ডাক্তার-বদ্যি, মানে পাড়ার একজন খুব ভালো হোমিওপ্যাথি–তার কাছ থেকেই ওষুধ এনে দিয়েছিলাম। কিন্তু খেলেই না ওষুধ। পড়ে থাকলো। চিরকালের জেদি তো। ওই মনের গুণেই কখনো শান্তি পেল না। তুমি তো দেখেছে মামী, চিরকালটা সাধ্যের অতিরিক্ত করলাম। তবু কখনো মন উঠলো না।
শ্যামাসুন্দরী ব্যস্ত গলায় বলেন, আহা, মন মন করেই বা দোষ দিচ্ছ কেন বাবা? মানুষের দেহেই কি ব্যাধি হয় না?
শ্যামাসুন্দরী চলে যেতেই প্ৰবোধ পাড়ার ব্ৰজেন কবরেজকে ডেকে আনলো।
সুবৰ্ণলতাকে উদ্দেশ করে দরাজ গলায় বললে, এই যে কবরেজ মশাই এসেছেন। নাও এখন বলো, তোমার অসুখটা কী?
এঁদের দেখেই চমকে উঠে বসে মাথায় কাপড় টেনে দিয়েছিল সুবর্ণ। কবিরাজ মশাই একই দেখি তো মা হাতটা— বলে নিজের হস্ত প্রসারণ করতেই দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলো, আপনাকে অকারণ কষ্ট দেওয়া হলো কবিরাজ মশাই, কোথাও কোনো অসুখ আমার নেই।